Thursday, October 15, 2015

দুর্গা লাইভ



ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় 

এবার আমাদের পাড়ার পুজোর থিম ছিল লাইভ ঠাকুর  । আইডিয়াটা রূপাদেবীর মস্তিস্কপ্রসূত। রূপাদেবী আমাদের পাড়ার মহিলাদের প্রতিনিধি। মেয়েদের অধিকার, মেয়েদের সম্মান সবকিছু  শক্তহাতে ধরে রেখেছেন বহুদিন ধরে। এ পাড়ায় কেউ ভাবতেই পারেনা ইভটিজিং বা রেপের মত অপকম্মের কথা ।  সেই রূপাদেবী একসন্ধ্যায় পুজোর মিটিংয়ে ঠিক করলেন, এবার প্যান্ডেলে নো নাচাগানা, হাস্যকৌতুক। প্রতিদিন সন্ধ্যেয় একঘন্টা করে লাইভ শো হবে।   
পাড়ার ছেলেরা মুখ চাওয়াচাউয়ি করল বটে কিন্তু রূপাদেবীর কথার ওপর কারোর কথা টেঁকলো না। "মাই চয়েস' এর দাপট নেই তাঁর ভাষায় কিন্তু ওনার হাসিতেই সব মাত! ঠিক যেন সাক্ষাত মাদুর্গা তিনি।

 মোড়ের মাথার মিষ্টির দোকানের ময়রার বেশ মোটাসোটা নাদুস নুদুস ছেলে  গোপলা  হয়েছিল গণেশ ।  বলিউডের স্বপ্নে বিভোর, চোখে সানগ্লাস,  বাহুর পেশীতে নিকষ কালো ট্যাটু আঁকা আর দুহাতে ঝিঞ্চ্যাক রিস্টলেট পরা  হৃত্তিক হয়েছিল কার্তিক । পাড়ার ছেলেদের  হার্টথ্রব স্মার্ট ও অতিসৌম্যা অণ্বেষা  হয়েছিল সরস্বতী, কিন্ডারগার্টেনের টিচার সে ।  লক্ষ্মী সেজেছে সদাহাস্যাময়ী  টুম্পা । এনজিওতে কাজ করে  ।
আর মাদুর্গার বেশে দশাশয়ী,  লাবণ্যময়ী  রূপাদেবী । তিনি  সমাজসেবিকা, দেখতেও প্রতিমার মত ।  

সবুজসঙ্ঘ  ক্লাবে জোরকদমে অনুশীলন হল  ।  জ্যান্ত দুর্গা ও  তাঁর ব্যাটেলিয়ন পুজোর ক'দিন শুধু সেজেগুজেই বসে  ছিলনা   । রোজ রাতে  প্যান্ডেলে তাদের নিয়ে নাটকের মহড়া চলত  । মজার নাটক লিখেছে পাড়ারই ছেলে মাছওয়ালা সৌরভ । সৌরভ খুব সৃষ্টিশীল। একহাতে মাছ কাটে অন্যহাতে কবিতা লিখতে পারে। তাই তার হাতে স্ক্রিপ্ট লেখার ভার।   পল্লীরক্ষা কমিটির পান্ডা কালিপদ সেজেছিল  অসুর । ষন্ডামার্কা চেহারা, ইয়া মোটা গোঁফ, কুচকুচে কালো গায়ের রঙ তার  ।  একটু গেঁটে বাত আছে এই যা!  তাছাড়া সব ঠিকঠাক।

সপ্তমীর দিনটা...

ওদিকে মঞ্চের পেছন থেকে আওয়াজ ভেসে আসে মাদুর্গার কানে। গ্রিণরুমে সাজগোজ চলছে। আর চলছে খোশমেজাজে গল্পগাছা।

গণেশ বলছিল, কতদিন ম্যাগি খাইনা ! দোকানবাজার, শপিংমল সর্বত্র ম্যাগি হাওয়া হয়ে গেল রাতারাতি!
কার্তিক বলে, আবারো সে ফিরিয়া আসিল বলিয়া, চিন্তা নেই তোর! 
লক্ষ্মী বলছিল ক্যাশকান্ডের কথা। শুনেছিস কখনো তোরা? বাবারে, মারে! এত্তটাকা? বাবার জন্মে চোখে দেখার কথা তো ভাবিওনি আর গল্পেও পড়িনিরে! 
সরস্বতী বলল, এটাই যুগ। ঘুষ নিয়ে বড়োলোক হওয়ার রেওয়াজ চলে আসছে সেই রবার্ট ক্লাইভের আমল থেকে। এতো কোন ছার্! যাক ঘুসুড়ির ঐ ঘুষখোর আজ সেলিব্রিটি হয়ে গেল । কাগজে, টিভিতে সকলে একবাক্যে লোকটাকে চেনে। আমাকে, তোকে কি কেউ চিনবে এজন্মে?
লক্ষ্মী বলল, আমার চাইনা অমন নেগেটিভ ইমেজ। 

অসুরের সাথে কথা হচ্ছিল নাট্যকার কাম মাছব্যাবসায়ী কাম কবি সৌরভের। সৌরভ স্ক্রিপ্টের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলছিল, গুরু, তোমার গোঁফজোড়াটা যা হয়েচে না? পুজোর পরেও কেটোনি যেন। ব্যাপক মানিয়েচে তোমার গায়ের রংয়ের সাথে। সেই লোমশমুনির মত তোমার বডি আর বাবরি বাবরি চুলগুলো যা কার্ল করেচ কত্তা !   অসুর বলে কথা! যাক্‌, একটা বিড়ি দাওনা বস্!
অসুর বলল, যা ফোট, আর বিড়ি নেই। টেনশানে সব শেষ করে ফেলেচি। এখন বাইরেও যাওয়া যাবেনি। 
ক্রুদ্ধ সৌরভ বললে, ছিলে সারদার এজেন্ট, হলে অসুর! সিবিআই জানতে পারলে নাটক করা বের করে দেবে।  কেসটা দেখেছো তো! অসুর ট্যাঁকের কোমরবন্ধ সরিয়ে তার মধ্যে থেকে একখানা চিঁড়েচ্যাপটা বিড়ি ধরিয়ে সৌরভের হাতে দিলে। আর বললে, কেন এমন করে মাঝেমাঝেই সারদার খোঁচাটা মারিস বলতো? এই সরাদার যখন রমরমা ছিল তোকে কতবার স্টেজ দিয়েছে বলতো! মঞ্চে উঠেচিস, কবিতা পড়েচিস, পয়সাও পেয়েচিস। এখন না হয় নাটকফাটক লিখচিস, আমি আলাপ না করিয়ে দিলে কে তোকে এজেন্টের কাজটা দিত বুঝি? ঐ মাছের ব্যাওসা করে কত টাকা থাকে তোর? সৌরভ বললে, থাক মামা, আমার ঘাট হয়েচে। আর পুরোণো কাসুন্দি ঘেঁটোনি। কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে। 

লাইটম্যান কল্যাণের সাথে সাউন্ডের তাপসের অহি নকুল সম্পর্ক। হঠাত মঞ্চে আলো জ্বলেই নিভে যাচ্ছে কেন? আবার ঝোলানো মাইকগুলোতে সাউন্ড এসেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কেন? আলো জ্বললে সাউন্ড নেই, সাউন্ড এলে আলো বন্ধ।  
কল্যাণ তাপসের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, রবিনসন স্ট্রীটের বাড়িতে যাওয়া আসা ছিল এনার। বাবু আবার আজ এখানে কি কঙ্কালকান্ড বানাবে দেখা যাক ।
তাপস ইলেকট্রিকের তারগুলো গোটাতে গোটাতে আড়চোখে চেয়ে বলল,  ঐসব তারগুলো বিষাক্ত হয়ে গেছে। এগুলো এখুনি পাল্টানো দরকার। যাদবপুর থেকে প্রেসিডেন্সি কোথায় না যায় তোর লাইট! সব স্টেজে আলো তোর একবগ্গা।
যাই রূপাদেবীকে বলি গিয়ে,  "ম্যাডাম !   হোক, হোক হোক কলরব!  এমন ইলেক্ট্রিকের তারে ফাংশান হবেনা। শেষে আমার সাউন্ডের বদনাম হযে যাবে '

সিংহ সাজানো হয়েচে ঐ পাড়ার একটা দোকানদারের ক্ষীণজীবি ছেলে পুঁটকে কে। তার জন্য এসেছে সিংহের পোষাক। কিন্তু সকলের খুব চিন্তা, পুঁটকে এই গরমে, অত আলোর মাঝে ঐ পোষাকটা পরে কতক্ষণ হাঁটু মুড়ে বসে থাকবে ছেলেটা  ! এত সুইট কিন্তু বড্ড ধুবলাপাতলা। রূপাদেবী ফ্লাস্কে করে গ্লুকন ডি গুলে আনেন পুঁটকের জন্যে। পুঁটকে যাতে কাহিল না হয়ে পড়ে। সকলের খুব চিন্তা তাকে নিয়ে । রূপাদেবীর পায়ের নীচে অতক্ষণ ধরে বসে থাকা কি চাড্ডিখানি কথা! 
পশুরাজবেশী পুঁটকে বলল, রূপা আন্টি ! আপনার পাদুটো বেশিক্ষণ যেন আমার পিঠের ওপর রাখবেননা। আমি তাহলে আজ রাতেই ....পুঁটকের কথা শেষ হতে না হতেই পাড়ার গৌরব হৃত্তিক বললে, আহহা! তুই একদম চিন্তা করিসনা পুঁটকে! রূপা আন্টির সব ব্যাবস্থা করা আছে। ওনার বাড়ির পোষা কুকুর, পাড়ার লেড়ি সকলের জন্যে আমাদের হাসপাতালে ডায়রিয়া টু ডায়ালিসিস সব চিকিত্সার সুবন্দোবস্ত আছে। তাই সারমেয় টু সিংহ সকলেই সেখানে রাজার হালে ট্রিটমেন্ট পাবে। আফটার অল তুই মানুষ। অতএব কোনো চিন্তা নেই তোর! 

রূপাদেবীকে একটু তোল্লাই দিয়ে  গণেশের বেশে গোপালটা পেট চুলকাতে চুলকাতে বলল, মাতৃভূমির ব্যাপার স্যাপার রাজকীয় বস্!  এমন পাড়াটি কোথাও খুঁজে পাবেনাকো তুমি!

ব্যাস্! অসুরবেশী কালীপদ গেল ক্ষেপে! মাত্তিভূমি কেন বলচিস্‌? পিত্তিভূমিও তো হতে পারে! মেয়েরা কি একা রাজত্ব করচে এদেশে? না কি মেয়েরা একা একা পারবে? বলি পুরুষ ছাড়া কোন্‌ মেয়ের জীবনটা সম্পূর্ণ হয় ....বলি এই জন্যেই তো সেদিন টেরেনে কত কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি হল, পাথর ছুঁড়ে কত কিত্তি হল  তারপরেও তোরা মাত্তিভূমি, মাত্তিভূমি বলে চেঁচাবি? ধর্‌, এই নাটকটাই রূপা ম্যাডাম কেবল দুগ্গা, সরোসতী আর লক্কি নিয়ে মঞ্চস্থ করতে পারতেন? এই নাটকে আমরা পুরুষরা দলে ভারি...হ্যাঁ, এই বলে দিলুম।


আলোয় উদ্ভাসিত সবুজসঙ্ঘের জ্যান্ত দুর্গা বাহিনী ।    

গণেশ :  এবার ক'দিন জিমে যেতেই হবে,  মিষ্টি আর ছোঁবনা। ওদিকে সুগারফ্রিতেও নাকি বিষ আছে বলছে ডাক্তারবাবুরা! 

লক্ষ্মী :  বরং একটা ট্রেডমিল সিংহের পিঠে করে নিয়ে আয় আর তোর ঐ ফালতু রেসলিউশান গুলো "মিষ্টি খাবোনা, মিষ্টি ছোঁবনা' রাখ্‌ তো !   

সরস্বতী : একটা বেস গীটার কিনতে হবে ।  রুদ্রবীণা পুরোণো । বুঝলি? আজকাল পাতি গীটারে গান করলে কেউ পাত্তাই দেয়না! শিল্পীর একটা ফাংশানে যতগুলো গান গায় তার দ্বিগুণ যান্ত্রানুষঙ্গ না থাকলে শিল্পীর গানের কোনো কদরই হয়না! 

কার্তিক  : মায়ের স্কোয়্যার, অল রাউন্ডার মেয়ে।  পড়াশোনায় ফার্স্ট, কম্পিউটারে তুখোড়, গানে সঙ্গীতরত্ন! এসবের রহস্য কি মা? কি খাওয়াও তোমার আদরের মেয়েকে চুপিচুপি?   আদর দিয়ে ছোট থেকে মাথায় তুলেছ মেয়েকে !  কম আদিখ্যেতা করলে ! আমার বেলাতেই  যত কর বসানো । নবমীতে আমি কিন্তু পার্কস্ট্রীট তন্ত্রে যাব । সেলফোন বন্ধ থাকবে ।

দুর্গা : ওরে! আমার হাতের পাঁচটা আঙুল এক। আমি মা হয়ে কখনো পক্ষপাতিত্ত্ব করতে পারি? তবে কার্তিক, বাবা তোর কাছে আমার একটাই অনুরোধ!  তোদের  বাপের একপয়সা রোজগারের মুরদ নেই আর ছেলেমেয়েরা ফূর্তি করে  ভাঙিয়ে খেয়ে শেষ করলে বড্ড খারাপ লাগে। 

গণেশ : বাবা ভাঙ খান, আমরা ভাঙিয়ে খাই । এ আর নতুন কি মা? 

দুর্গা : তোরা  বিয়েটিয়ে করে আমাকে একটু শান্তি দিবি ? স্থায়ী একটা সংসার পাতবি ? আমাকে দেখ  ! ঐ পাগলছাগল  নিয়ে, ওর নেশাটেশা  মেনে নিয়ে আজীবন কাটিয়ে দিলাম

লক্ষ্মী :  বিয়ে করে সংসার পাতলেই  মোক্ষলাভ  ?  কৈলাসে বেম্মা, বিষ্ণু, বাবার আওতায়  থাকলে কিস্যুটি হবেনা ।  পাততাড়ি গোটাতে হবে । বদলের বঙ্গে সব দেখেশুনে আসব । এখন বিয়ে অবসোলিট। লিভ-ইন করব আমরা । 

সরস্বতী  :   একদম ঠিক বলেচিস। লিভ-টুগেদার ইজ  বেটার দ্যান ম্যারেজ। বাই দ্যা ওয়ে  মা, এই গরমে ওখানে এবার আর সিল্কের শাড়ি পরবনা কিন্তু ।   ঢাকাই মসলিন  হালকা  আর বাংলায় গিয়ে  ঢাকাই  না পরলে ইজ্জত থাকেনা । একে তো বাবা চাকরীবাকরী করেনা, নেশাটেশা করে বলে মামারবাড়ির সকলে আমাদের একটু হেয় করে ।

 দুর্গা : ভাবছি এবার দশহাতার ব্লাউজ করাব না । স্পন্ডোলিসিসের  কারণে  পিঠের  ব্যাথাটা যা বেড়েছে অতগুলো হাতা পরতে বড্ড কষ্ট হয় ।

অসুরের বেশে কালীপদ ব্যথার কথা শুনে চীত্কার করে বলে উঠল,  "মা গো  ! আজ এক টিউব ভোলিনি দিতে ভুলোনি মাগো!  এবার ক্ষান্ত দাও, তোমার পায়ের নীচে বসে বসে আমার কোমরে মস্ত ফিক লেগে গেছে '

মঞ্চের আলো নিভল। হাসিতে ফেটে পড়ল দর্শককুল। স্ক্রিপ্ট রাইটার সৌরভ আড়াল থেকে প্রম্পট করছিল। সে তো হেসেই খুন। সে গ্রিণরুমের দিকে যেতেই দেখা হল জ্যান্ত দুর্গাবাহিনীর সকলের সাথে।  প্রথমেই তার করমর্দণ হল কালীপদর সাথে... "ফাটিয়ে দিয়েছো গুরু! কালীপদদা! এবার বঙ্গভূষণটা তোমার কপালেই!  '
অসুরবেশী কালীপদ বলল, "কেউ বুঝতে পারেনি তো ? '
সৌরভ বলল, "আরে নাহ্! ঐ ভীড়ের মধ্যে কে বুঝবে? তোমার ডায়লগটা তো এত প্রাণবন্ত ছিল! আমি ধরতে পারিনি তো ওরা কোন ছার! '
সমাজসেবিকা রূপাদেবী দুর্গার বেশ পরেই গ্রিণরুমে গিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে একটা একশোটাকার নোট বের করে সৌরভের হাতে দিয়ে বললেন' একটা ভোলিনি স্প্রে এনে দে এক্ষুণি, নয়তো আধঘন্টা বাদে পরের লাইভ শো'টা ক্যাচাল হয়ে যাবে কালীপদর জন্য।  এখনো বাকী আছে তিনদিন। আজ তো মোটে সপ্তমী!

আমেরিকা থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন "দুকুল" অক্টোবর ২০১৫

No comments:

Post a Comment