Thursday, October 15, 2015

পুজোর বাজার ও ফেসবুকীয়

  যাঃ ছাতা! ধুস্‌  ! এমন জলেকাদায় পুজোর বাজার হয় নাকি?  বিষ্টি ব্যাটাচ্ছেলে এভাবেই দাপিয়ে চলবে পচা ভাদ্রের পুজোবাজারে?  দোকানিদের হয়রানি আর বিক্রেতার ঝামেলা। শুধু শপিং মলে আর বাড়ির মধ্যে বুটিকগুলির খুব মজা। বিরক্তি সবেতেই। শপিং মলে বৌদিরা দরদাম করতে পারেননা বলে মনখারাপ। আবার শপিংমলে বিষ্টি থেকে রেহাই। বাতানুকুল পরিবেশে মনটাও ফুরফুরে থাকে। ব্লাডপ্রেসার বাড়েনা। তবে দামটা...
আর তুমি ফুটপাথে বারগেন করেছ বলে ভাবছ খুব জিতেছ তাইনা? মোটেও না। ফুটপাথের জিনিসে সস্তার তিন অবস্থা। পুজোয় পরো। জলে দাও তারপর ভুরভুর করে রং গেল উঠে। অথবা মহাষ্টমীর রাতেই সেলাই গেল ফেঁসে। কিম্বা নবমীর নিশিতে আবিষ্কার করলে শাড়িটার আসলে ব্লাউজপিস ছিলনা। ব্লাউজপিস কেটে দশহাতিতে দাঁড়িয়েছে। ষষ্ঠীর ভোরে বিছানার চাদর পাততে গিয়ে দেখলে সাত বাই পাঁচ খাটের চাদর গচিয়েছে তোমাকে সাত-ছয় বলে। আবার সপ্তমীর সন্ধ্যেবেলায় ছেলে বন্ধুদের সাথে বেরুতে গিয়ে দেখল অতি পছন্দের টিশার্টটা আসলে এক্সেল নয়, আদতে তা স্মল সাইজ।  তারপর কুর্তির ঝুল, ফুর্তির মেজাজ, সোঁয়া ওঠা ঘিচা, মিসপ্রিন্ট কোটা,  ফুটোওলা মসলিন, সুতো সরে যাওয়া পশমিনা আর আহারে আমার বাহা শাড়ি!
ফেসবুকের রোশনিতো সেদিন ফুটপাথ বনাম শপিংমল নিয়ে পোষ্টেছিল স্টেট্যাসে। ব্যাস্! ঝড়ের বেগে পড়ল কমেন্ট। ফুটপাথকে ছোট করতে চায়না কোনো বঙ্গললনা। রোশনীর বন্ধু সায়নীতো আলটপকা বলেই ফেলল "রাখ‌ তোদের শপিংমল! আমার খাদির তসরের পাঞ্জাবীর রং উঠে শেষ। কটন কুর্তি জলে পড়ে হাঁটুর ওপরে উঠেছে আর কটন ইন্ডিয়ার পর্দাটায় একটা করে সিন্থেটিক সুতো আছে।
এবার বোঝো ঠ্যালা।
রোশনী ফুটপাথের ও ফরে নয়। সায়নী দোকানেরো ফরে নয়। ওদের দুজনের কমন ফ্রেন্ড বনানী ফুটপাথ আর দোকান দুটোতেই স্বাছন্দ্য বোধ করে। সেই নিয়ে কে যে ফুটপাথের হকারদের বিরুদ্ধে বলবে আর  কে শপিংমলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে তা বুঝে উঠতে পারেনা। হকারদের ফরে কথা বললে পাবলিক বলবে বর্তমান সরকারের ভাড়া করা ক্যাডার। শপিংমলের ফরে বললে বলবে অপোজিশনের চর। অতএব সেই কাজিয়া তুমুল থেকে তুমুলতর হল। 
অঞ্জলির ভোরে যাদেবী সর্বভূতেষু   বলতে বলতে চোখ বুঁজে ফুল ছুঁডতে গিয়েই বগলে টান পড়ল হেঁইও বলে। ব্যাস্!  আনকোরা রেডিমেড তসরের পাঞ্জাবীর বগলের দফা গয়া। বৌ সেই দেখে বলে উঠল
" ঠিক হয়েচে, আবারো যাও তোমার দামী দোকানে।  এবার কি হবে?”
বলতে বলতেই বিষ্টির জলে রাস্তা থৈ থৈ। এবার কত্তা-গিন্নী অঞ্জলী দিয়ে খালিপেটে রাস্তা পেরিয়ে যাবে কচুরীর দোকানে। ব্যাস্!  থ্যাপ্‌, থ্যাপ্‌! চুপচাপ ফুলে ছাপের মত গিন্নীর গরদে ক্লড মোনের ইম্প্রেশানিষ্ট পেন্টিং!    গিন্নীর লুটোনো সিল্কের গরদে ব্রাইট পাড়ের রং লেগে গেল শাড়ির সাদা জমিনে! কর্তা বলে, এবার দেখো, তেরে জমিন পর্! ঐ গড়িয়াহাটার ফুটপাথের দেওরগুলো কেমন গরদ গচিয়েছে দ্যাখো দিকিনি! বৌদি বৌদি বলে অজ্ঞান ছোঁডাগুলো।  যেন মাইরি মাইরি কচ্চে ছোঁড়াগুলো! 
তখন পেটে খিদের জ্বালা আর তাতে শাড়ির রং তোলা এই টানাপোড়েনে কর্তা-গিন্নীর অষ্টমীপুজো শিকেয় উঠল। 
শাড়ির দোকানেও দালালি করে ঐ দেওরগুলো! বৌদি এই দোকানে আসুন, অপর্ণা সেনের প্রিয় দোকান। নয়ত বধূঠাকুরাণীর হাটে আসুন। মুনমুন সেন এখান থেকে শাড়ি কেনেন। অথবা আরো লোক টানতে সোজা বলিউড পৌঁছে যায়। বাংলার মেয়ে রাণী মুখার্জি পোত্যেকবার পুজোর আগে আমাদের এই দোকান থেকে ঢাকাই কিনে নিয়ে যান। ঐ যে বালীগঞ্জ কালচারের সামনে কাহানীর স্যুটিংয়ে সব লাল-সাদা গরদ্ গুলো দেখেছিলেন বৌদি ওগুলো সব আমাদের দোকানের... বিদ্যা বালন  এবারে দশখানা গরদ মুম্বাইতে  কিনে নিয়ে গেলেন । তুমিও গলে আইসক্রিমের আনন্দে ঐ গরদ কিনে ফেললে । এবার লে ছক্কা!  ব্যুটিক শাড়ি বৌদি। পোত্যেকটা ইউনিক পিছ। ডুপ্লিকেট হবেনা আমাদের কাপড়। গতবারেও তো ঠকেছিলে গিন্নী। মটকা না ফটকা কি একটা বলেছিল তোমাকে। পরে দেখলে ওটা আসলে নিপাট পাটের শাড়ি। দোকানের আশেপাশেই অপেক্ষা করে থাকে । ঝোঁপ বুঝে কোপ মারে। বেশ গোবেচারা, ভালোমানুষ দেখে দালালের চৌম্বকীয় টান সম্মোহন বিদ্যার ভেলকিতে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যায় সেই দোকানের দরজার দিকে। ব্যাস্! একবার নিয়ে যেতে পারলেই সেদিনকার মত একটা দালালিতো পাবেই সে ।
তার আর কি দোষ বলো? গিন্নী বলে ওঠে। চাকরীবাকরী নেই, শিল্প নেই, কলকারখানা যাও বা ছিল সব বন্ধ হয়ে লাটে উঠেছে সে লোকটাকেও তো করে খেতে হবে। সে তো আর চুরি করছেনা! 

আর তুমি বুঝি ঠকোনি? ঐ এসির লোভে নামী  দোকান থেকে গতবছর সুতির পাঞ্জাবী কিনে নিয়ে এসে পরে  দশমীর ঠাকুর ভাসান থেকে ফিরলে ! সারা গায়ে আমবাতের মত দাগড়া দাগড়া ঘামাচির মত ছাইপাঁশ বেরুলো! ডাক্তার তো ভয়ে তোমাকে ষ্টেরয়েড দিয়ে দিতে বাধ্য হল। সিন্থেটিক পাঞ্জাবী পিওর কটন বলে চালিয়ে দিল আর আবার এবছর ওদের দোকান থেকেই তসরের পাঞ্জাবী কিনলে অত্ত দাম দিয়ে?  
পুজোর বাজার, সাজুগুজুর রমরমা, একসেসারিজ, মেহেন্দী, স্পা সব মিলিয়ে ঘেঁটে ঘ ফুটপাথ। কি সব আগডুম বাগডুম রংকে মেহেন্দী বলে  লাগিয়ে রোশনীর কাজের মেয়েটার দুহাত ফুলে সুমো রেস্টলারের সাইজ!  চুলকে মরে গেল মেয়েটা। বাসন মাজা, কাপড়কাচা, ঘরমোছার হাত বলে কতা। এখন রোশনীকেই সামাল দিতে হচ্ছে। তাই কাজের ফাঁকেই উগরে দিল খানিকটা ফেসবুক পাড়ায়। বারণ করেছিলাম ওকে, শুনলোনা। এবার একাহাতে ডাক্তারবদ্যি প্লাস কাজগুলো সব সামলাচ্ছি বন্ধুরা... ।

বলতে না বলতেই পড়ল কথা সবার মাঝে, যার কথা তার গায়ে বাজে। সায়নী বলল ঐ মেহেন্দীওলাকে পুলিশে দেওয়া উচিত! বনানী বলল আরে গতবছর গড়িয়াহাটের ফুটপাথে ট্যাটু করতে গিয়ে আমার ড্রাইভারটার সে কি বিপত্তি। গাড়ি চালানোর হাত বলে কথা। বিষিয়ে গিয়ে কেলেঙ্কারি।
 রোশনী, সায়নী ও বনানীর কমন ফ্রেন্ড উজ্জলদা বললেন রেজিষ্ট্রেশান নেই কিছুনা,  সকলেই বিজনেস কচ্চে কলকাতার ফুটপাথে। বাঙালী জেগেছে, প্রফুল্লচন্দ্রের কথা মাথায় নিয়ে বাণিজ্যে বসেছে বাঙালী।   সস্তার জিনিষ, সস্তার রং ব্যাবহার করে মানুষকে বোকা বানাচ্ছে আর আমাদের সরকার ? তাঁর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই সেদিকে? সাথে সাথে পটাপট উত্তর ফেসবুক দেওয়ালে।
আরে মশাই, সরকার রাজ্য শাসন করবে না মেহেন্দীর রং গুলবে? রাস্তা সারাবে না কি ট্যাটু নিয়ে রিসার্চ করবে?  সরকারকে মিছে দোষ দেন আপনারা! এই হল আপনাদের এক মহাদোষ! দেখছেন টালার জলট্যাংকি রং হচ্ছেনা কত বছর ধরে, আর তিনি কিনা মেহেন্দীর রং নিয়ে পড়ে থাকবেন !

তাহলে তো ফুটপাথের মোমো বিক্রেতা থেকে শুরু করে আখের রস সকলকেই জেলে পুরতে হয়। জনৈক ফেসবুকার বলে... 
আরে দাঁড়াও তেনারা নিজেরাই ল্যাজে গোবরে। সারদা মায়ের নাম নিয়ে  ব্যবসায় নেমে কি ঝক্কি বলো দিকিনি!  আরেকজন বলল, সব কপাল বুঝলে ভায়া? বাজার যাবার সময় রোজ বস্তির একটা মেয়েছেলে সকলকে ফুঁসলোত, আমি নিজের চোখে দেখেছি গো। বাজারের আলু ওলা, পটল ওলা সকলের কাছ থেকে দশটা করে  টাকা  কালেক্ট করত। আর তোতাপাখির মত বলে যেত, রোজ দশ করে দাও, সারদা লাখপতি বানাবে তোমাকে। আমার নিজের কানে শোনা এসব।   

বলিহারী ফেসবুক বাপু! কারোকে ছেড়ে কতা কোস্‌ না তোরা। বনানীর মা মেয়ের  ল্যাপটপের পাশে বসে ফোড়ন কাটেন। চড়বড় করে ফোড়ন যেন ছিটকেই আছড়ে পড়ে এলসিডি স্ক্রিনে। এই গেল শূয়োরের বাচ্ছাদের নিয়ে মায়েদের রিহ্যাব নিয়ে, তারপর পাল নিয়ে টালমাটাল দিনকয়েক, তারপর ছাত্রদের ত্রি-শঙ্কু অবস্থা হয়ে ঝুলে থাকা,  আর এখন তো টিভি খুলতেই পারছিনা ...সারদা-রামকৃষ্ণতে অরুচি ধরে গেলরে! তাই তো টিভি বন্ধ করে তোর পাশে বসে ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখশুদ্ধি করছি।

তাই করো মা, ফেসবুকে ঢুকে পড়ো টুক করে!

যাই বাপু আজ্! ওদিকে পাড়ার প্যান্ডেলে আজ পুজোর মিটিং আছে। আমাকে সভানেত্রী করেছে ওরা। তিলোত্তমার মেয়ের বিয়ে বলে কতা! বছরে তো একবার । ফেসবুক তো বারবার !
("এইসময়" ব্লগ )

No comments:

Post a Comment