Sunday, June 28, 2015

বাঁশে তেলে

যাদব চকোত্তির পাটীগণিত ব‌ইয়ের বাঁদরের সেই বিখ্যাত অঙ্ক মনে পড়ে ? বাঁশের গায়ে তেল মাখানো, বাঁদর কিছুটা ওঠে তো কিছুটা নামে.. এই আমার মত অনামা লেখকের মত । একটু উঠলেই মনে হয় অনেকটা পথ গেলাম । পরক্ষণেই সম্পাদকের অপছন্দের মেল আসে উড়ে। আবার নামো ঐ বাঁদরের মত। চিরটাকাল ঐ অঙ্কটাকে ভয় পেয়ে গেলাম আর সেই অঙ্ক‌ই আমায় তাড়িয়ে নিয়ে চলল সারাটা জীবন ধরে। আমার মা বলতেন সংসারে যে সহে, সে রহে, সারদামায়ের কথা। সেই আপ্তবাক্য মাথায় করেই চলি। তবে বাঁদর হতে চাইনে। স্বামী বলেন বাঁদর আর খারাপ কি হল? রামচন্দ্রের সেতু বাঁধার সময় কত কত বাঁদর তাঁকে সাহায্য করে ফেমাস হয়ে গেল। তুমিও তো বাঁদর হয়ে সেলেব হতে পারো। শ্বশুরবাড়িতেও সেই এক টানা আর পোড়েন। আমার দিন যাপনের চিত্রটা সেই বাঁদরের মত‌ই থেকে গেল শয়নে, স্বপনে, জাগরণে। একহাতে ঝিনুকবাটি অন্যহাতে দাঁতকপাটি। সকলের মন জুগিয়ে চলো। তরতর করে পার হবে বৈতরণীর ঢেউ। একটু তেল কম পড়েছে তো ব্যাস্! পা স্লিপ করে নামো সেই সাপলুডোর নিরানব্ব‌ইয়ের ঘর থেকে সজোরে শূন্যোয়। আপাতভাবে মনে হচ্ছে তো ? যে তেল কম পড়লে স্লিপ করবে কেন? তেল বেশী দিলেই তো স্লিপ করে পড়ার কথা। কিন্তু না, সংসারে তা হয়না বন্ধু। তেল কম পড়লেই পা স্লিপ করে। তাই গরগরে কালিয়া কিম্বা তেলে চুপচুপে বেগুনীর মত করে তেল ঢেলে যেতেই হয় এখানে, অহোরাত্র। আরে মশাই সংসারটাও তো রাজনীতির জায়গা না কি! স্বামী এদ্দিন বাদে বললেন ফিসফিস করে। বাড়ির ভেতরে চাপা চাপা রাজনীতি। বাম আছে, ডান আছে। কৌরব আছে, পান্ডব‌ও আছে। লুডোর চালটা তোমার হাতে। সেখানে মন্থরা আছে, কৈকেয়ী আছে। শকুনিও আছে রিভেঞ্জ নেওয়ার জন্যে। তোমাকে এত্তগুলো প্যারামিটার কব্জা করে একহাতে বাঁশ ধরতে হবে শক্ত করে আর অন্য হাতে নিতে হবে তেলের বাটি। সব তেল চলবেনা। একটু দামী তেল নিতে হবে মানে অলিভ অয়েল হলেই বেষ্ট। কোলাপ্সিবল গেটের না হয় কঠিন হৃদয়, পোড়া মোবিলেও মন ভেজে তার কিন্তু মানুষ যে বাঁদরের উত্তরপুরুষ তার তো চাই খাঁটি তেল। অবশেষে একস্ট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল নিয়ে এলাম। হাজার টাকা কিলো বলে কতা! সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবেনা। সকলের হৃদয়ের খেয়ালও হল, আবার আমার বাঁশটা একটু বেশিই তৈলাক্ত হল। অতএব এগোও চটপট। কৌরবপক্ষ আপাতত মুখে কুলুপ। হঠাত একদিন দুপুরে তাদের ইচ্ছে হল অপন্না সেনের "গয়নার বাস্ক" খুলে দেখার । বুক মাই শো! বাড়ির নাকের ডগায় সিনেমা! কত যত্ন করে, নো রিফিউসাল ট্যাক্সি করে সিনেমায় নিয়ে গেনু, হাফটাইমে চিপ্স-পপকর্ণ খাওয়ানু, বেরিয়ে এসে এগ-চিকেন রোল অর্ডার দিনু! পরদিন লেডিজ পার্কে হাঁটতে গিয়ে ফিরে এসে শাউড়িটা কি নেমোখারামি কল্লে! বলে কিনা তার বান্ধবীরা মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখতে গেচে, পিত্জা খেয়েচে আরো কত কি! মানে আমার সব তেল জ্বলে শেষ এক নিমেষে! বুঝলাম আরো তেল চাই নয়ত আমার বাঁশ আর আমাকে নিয়ে যাবেনা একটুও। আর আমার ঐ জা'টা সে কেবলি কুমন্ত্রণা দেয় কানে কানে! বলে যেমন আপনি আদিখ্যেতা করেন আপনার ছোটোবৌমাকে নিয়ে! সেবার সাধে দিয়ে দিলেন সলিড সোনার ধেড়ি ঝুম্কো, আর আমার বেলায় ঝুটো পাথরের দুল ! গয়নার বাস্ক দেখে এসে ওবধি বুড়িটা খুব হুঁশিয়ার হয়েচে, বলে আর আঁচলের চাবির গোচা ভুলেও তোমাদের কাচে নয়! নাহ্! বিশ্বাস নেই! আমার জা যখন যেমন তখন তেমন, যেখানে যেমন, সেখানে তেমন। সাপের গালেও হামি খায় , ব্যাঙের জিভেও জিভ ঠেকায়। চোর কে বলে চুরি করতে আর গেরস্তকে বলে সাবধান হতে। প্রথম প্রথম বুঝতামনা। আমাকে সিনেমা দেখাচ্ছে, কবিরাজী কাটলেট খাওয়াচ্ছে আবার আমার বাপেরবাড়ি যাত্রায় আল্হাদে আটখানি হয়ে আমার শাশুড়ি মা'কে বিলাতি আইসক্রিম খাওয়াচ্ছে। বাসকিন রবিনস খেয়ে তেনার কি আনন্দ ! এসেই দেখি পার্টিতে দিদিভাইয়ের গলায় তেনার জাল-ফাঁশ হারখানা। মনে মনে বলে উঠি "এ মনিহার আমার গলে নাহি সাজে দিদিভাই" তুমি জালি করো আর আমায় ফাঁসিয়ে দিতে ওস্তাদ এক মহিলা অতএব "বধু ধরো ধরো মালা পরো গলে!" কাজের লোক না এলে রান্নাবাড়ি, ঝাড়াপোঁচা, বাসন-কাপড় সব আমার ভাগে। কেন না বড় বৌমা ইস্কুলের দিদিমণি। মাস গেলে চাঁদির জুতোর তৈলাক্ত শুকতলা দিয়ে তেনার জন্যে পয়লা বোশেখে স্লিভলেস হাউসকোট, বলরামের সুগারফ্রি মিষ্টি, মনজিনিসের মনের মত জিনিষ, তেনাদের শোবার ঘরের লেসের পর্দার কাপড়, পুজোর সময় জরিপাড় সাউথ কটন আসে। না হয় সেগুলো আমার অলিভ অয়েলের চেয়েও ঢের দামী তাই বলে ওনাকে একটু রান্নাঘরে যেতে বললেই বলেন সংসার আমার নয়, তোমাদের। বাড়ি আমার। বোঝো ঠ্যালা! আরে ভাই এতো সেই মুকুল মার্কা কতা হল! আমি সরকারের কেউ ন‌ই। আমি দলের । অবশেষে বাঁশ আবার ছুলতে বসি। আরো মসৃণ হবে পথ। মাখাই হরেক কিসিমের ঘি, মাখন, রিফাইন্ড অয়েল। তবুও সুযোগ পেলেই বুড়িটা বাঁশ দেয় আমাকে। যাকে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা। ওনার বাঁশটা ইসপেশাল বাঁশ, মানে ইংরেজীতে যাকে বলে "বাম্বু" । অদৃশ্য বাম্বু। ওনার মাথার বাঁদিকের কোনো এক চোরাকুঠুরিতে রাখা থাকে। আর পারলে উনি না ছুলেই প্রয়োগ করেন সেটি, কখনো আমার ওপর কখনো বুড়ো শ্বশুরটার ওপর, অথবা আমার একমাত্র গৃহপালিত স্বামীটির ওপর। একদিন হয়েচে কি আমার উনি ওনার উনিকে চুপিচুপি বলচেন, বাবা, চলো আমরা একদিন সকলে মিলে হোটেলে খাই। উনি শুনতে পেয়েই বললেন, "ঐ দ্যাকো, আবারো তেল দিচ্ছে আমাদের গো! ঐ যে পরের মাসে তোমার কিষাণ বিকাশটা ম্যাচিওর করচে, ঠিক খেয়াল আছে ওদের। উড়োজাহাজের মত বুদ্ধিটা বোধহয় বৌয়ের। মাগের ভেড়ো তো একটা। উঠচে আর বসচে ঐ মেয়েটার কতায়!” আমি পর্দার আড়াল থেকে একগাল হেসে বলি "উড়োজাহাজ না রকেট" । ঠিক অশ্বত্থামা হত ইতি গজর মত মৃদু স্বরে। কারণ তিনি শুনতে পেলেই ব্যস্! গুষ্টির তুষ্টি করে আমার ফষ্টিনষ্টি মাঠে মেরে দেবেন। বোঝো কান্ডটা! আমি হতভাগী জানিওনা ওনাদের কিষাণ বিকাশ আচে না ম্যাচিওর করচে! স্বামীকে বল্লুম, এমন করে আর থাকা যাচ্ছেনা, চলো আমরা অন্য কোথাও চলে যাই। শাউড়ি শুনলে আবারো বাণ মারবে আমাকে। এবার আমি রেডি হলুম মনে মনে। উনি বাণ মারলেই আমি যা মুখে আসবে তাই বলব। আবার ভাবছি বাঁশ দিতে গিয়ে বনফুলের "পোড়ার মুখী"র মত উল্টে আমার চোয়াল আটকে যাবেনা তো! বিয়ের পরদিন ঘোমটাটা এট্টু সরিয়েচি, ব্যাস্! উনি ক্ষেপে ব্যোম্‌ ! আর এখন নিজে স্লিভলেস নাইটি পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে ওপারের ফ্ল্যাটের মাসীমার সঙ্গে সিরিয়ালের কতো গপ্পো কচ্চেন? সেই সাথে আমাকে বাঁশ দেবার কৌশলটাও ঝালিয়ে নিচ্চেন। ঘরে এসেই ঐ মাসীমার ছেলে-বৌ তাদের কত সুখে রেখেচে তার ফিরিস্তি। মানে তেলও চাই আবার বাঁশ দেওয়াও চাই। ভুলি নাই ভুলি নাই সেদিনের কথা। একদিন দিদিভাই মানে আমার জা স্কুল থেকে আসতেই তাকে বললাম ব্যাপারটা। সে বলল, "ভালো তো আরো তেল মাখা, আরো ক্রেডিট নিতে যা, তোর বরাতে এমনি জুটবে। তুই কি ভাবছিস, এ সংসার রাজনীতির খেল? যে তেল মাখালো সে টেন্ডার পেল, আর কংক্রিটের জঙ্গল বানিয়ে পয়সা কামিয়ে নিল? মোটেও নয়, এখানে আছে সূক্ষাতিসূক্ষ সম্পর্কের টানাপোড়েন, বুঝলি। তুই যখন শাউড়ি হবি তখন তোর বৌও এক হাত মে তেল কা শিশি আর অন্যহাত মে বাঁশ নিয়ে খেলবে তোর সাথে। মেনোপজ বুঝলি না ? মেনোপজ হল যত্ত নষ্টের কারণ। উনি এখন টোট্যালি পজড আর তুই-আমি এপ্রোচিং । বুড়োটাও খিটখিটে, বুড়িটাও তাই। তেল দিলেও কোনো লাভ নেই। পারলে জাপানী তেল নিয়ে আয়। বুড়োটাকে গিফ্ট কর। বুড়োটা সোজা থাকলে বুড়িও আরাম পাবে। আর বুড়ি আরাম পেলে আর আমাদের পেছনে লাগবেনা, বুঝলি? “ কিন্তু সেদিন যে বুড়ি বলছিল, একটা বয়েসের পর স্বামী-স্ত্রী ভাই-বোনের মত বাস করবে, ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলে গেছেন। আরে ঐ জন্যেই তো বলচি তোকে, "সব কিছুর মূলে ঐ জাপানী তেলের খেল! মনে নেই সেই গ্রাইপ ওয়াটারের এডটা? বংশ পরম্পরায় চলতেই থাকে সদ্যোজাতের পেটব্যাথা আর তখন একমাত্র সুরাহা গ্রাইপ ওয়াটারে। আর তাহলেই দেখবি অচিরেই বুড়িটার সেই অদৃশ্য বাঁশটার ডগাটা ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে, মসৃণ থেকে মসৃণতর থেকে মসৃণতমের দিকে এগুচ্ছে। " সবশেষে বলি রান্নাঘরের রসনার তৃপ্তিও কিন্তু তেলে। বাংলার অন্যতম তেলেভাজা শিল্প থেকে শুরু করে তেল কৈ অথবা পাবদামাছের তেলঝাল এ সবের মূলে তেল। আর ঐ যে সব শিল্পকর্ম, অনুষ্ঠানের মঞ্চবাঁধা থেকে শুরু করে উঁচুবাড়ির ভারা বাঁধা কিম্বা কয়লার আঁচে পোড়ানো ম্যারিনেটেড মুরগীর টুকরোকে বাঁশের মধ্যে পুরে বাম্বুচিকেন??? এসবের মূলে কিন্তু বাঁশ। অতএব বাঁশ ও তেল এ দুয়ের সহাবস্থানে জীবন চলছে চলুক। যদি জীবন চায় আরো বেশিকিছু বাড়িয়ে কমিয়ে নিন না বাঁশের সাইজ ও তেলের পরিমাণ!!! যাক্‌ আর তেলা মাথায় তেল দিলাম না। বড্ড তেলতেলে হয়ে যাবে । তেলেভাজা শিল্প হয়ে আসুক সিঙ্গুরের শিল্পমাঠে। আর বাঁশ শিল্প হোক বাঙ্গালীর নন্দনে-বন্দনে। বাঁশের ফুলদানী, ল্যাম্পশেড নন্দিত হোক মেলাপ্রাঙ্গণে। বাঁশ আর তেলের জয় হোক! জয় বংশদন্ডের জয়! জয় তৈলশিল্পের জয়!

উত্তরবঙ্গ সংবাদ রবিবার  

হায়রে ! হিপোক্রেসী।

ঠাকুর রামকৃষ্ণ নাকি প্রায়শ‌ই বলতেন! দুস্‌ শালা! উনি বললে সাতখুন মাপ আর ছেলের সামনে ভুল করে "শালা" বলে ফেললেই ব্যাস্! সংসার রসাতলে। চায়ের দোকানের ভোরের আড্ডায় প্রবেশ করেই ভুতুবাবুর চোখ কপালে! দোকানের মালিক তখনো চা চাপায়নি। ভুতুবাবু বলে উঠলেন খচ্চরটা আজ দেরী করিয়েই ছাড়বে। দোকানের মালিক পটল বললে, ভুতোদা রাগ করছেন কেন? সক্কালবেলা গালাগালি না দিলেই নয়? ভুতুবাবু বললেন, শালা ! তোমার দোকানে চা খাওয়া বন্ধ করতেই হবে দেখছি। টিঙ্কুর মা আড়ালে কাজের লোককে ঝি-মাগি বলে। টিঙ্কু বোঝেনা তার মানে। একদিন সেই ঝি-মাগিটির সামনেই টিঙ্কু ফোনে বলে বসল, মা এখন ঝি-মাগীর সাথে রান্নাঘরে কাজ করছে। তারপর সেই ঝি-মাগিটি চলে গেলে টিঙ্কুর মা তো তাকে মেরেই ফেলে আর কি! শাশুড়ি বৌমাটিকে বলে মাথায় কাপড় দিতে আবার নিজে নাইটি পরিহিতা হয়ে বেডরুম থেকে সানন্দে লিভিং রুমে অবতীর্ণ হন একপাল জনতার সামনে। ছেলের ওপর বৌয়ের দখলদারির তীব্রতা প্রমাণ করতে মা ছেলেকে আখ্যা দিলেন "মাগের ভেড়ো" । সেই শুনে ছেলেও রেগে উত্তেজিত হয়ে মা'কে জবাব দিল "এ আর নতুন কথা কি! বাপ্‌ কা বেটা, বুঝলেনা? ঠাকুমা বাবাকে বলত "স্ত্রৈণ" মা বলল "চো‌ওপ্" !!! এভাবেই জল গড়িয়ে চলেছে ভারতবর্ষে। যার বাহুমূলে যত জোর, গালাগালি তার! রাজা শশাঙ্কের আমলে মাত্সন্যায় ছিল। এখনো সেই ট্র্যাডিশন চলে আসছে। সবল দুর্বলের ওপর অত্যাচার করবে এটাই তো স্বাভাবিক। সে ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ হোক, শ্বশুরবাড়ি হোক কিম্বা রাজনীতির আঙিনা। আধ্যাত্মিক কুশীলবেরাও কত ভুল করেন ভারতবর্ষের "ধার্মিক" প্রেক্ষাপটে। কিন্তু তেনারা হলেন রাজারাজড়া, দেবতার জাত। অতএব কিং ক্যান ডু নো রং ! ঠিক ঐ গালাগালি দেবার মত। আমরা, ধর্মভীরু ভারতবাসী যুগ যুগ ধরে চোখ বুঁজে ফুল ছুঁড়ে আসছি তাদের পায়ে । আসলে আমরা হনু হিপোক্রিট। হিপোক্রেসি আমাদের মজ্জাগত। দেবদেবী থেকে শুরু করে আমজনতা সকলেই যেন এক রকম। চৈত্রমাস নাকি মধুমাস। কারণ রামায়ণের হিরো রামের জন্মমাস। শুক্লা চৈত্রনবমীতে রামচন্দ্রের জন্মদিন। যে মানুষটা গণতান্ত্রিক স্বার্থে বৌকে ত্যাগ দিয়েছিল ? রাবণের ঘরে সীতার দিনযাপনকে কলঙ্কিত করে সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে বাধ্য করেছিল তার জন্য ঘটা করে জন্মদিন? মানতে বড় কষ্ট হয়। আদর্শবান পুরুষচরিত্র হয়েও সীতার দুঃখ বুঝতে পারেনি সে হেন পুরুষনায়কের জন্য ছেলের মায়েরা রামনবমীর উপবাস করেন। ভাবতে কষ্ট হয়। মনে মনে বলি, রামের চৈত্রমাস, সীতার সর্বনাশ। কৈ সীতার আত্মত্যাগের জন্য কেউ তো সীতার জন্মদিন পালন করেনা? রামকে নিয়ে কত ভজন গান হয়। কিন্তু সীতার জন্য ক'জন ভজন গান? এমনকি "পঞ্চকন্যা"... অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা ও মন্দোদরীর সাথে এক আসনেও সীতা স্মরেণ্যা ও বরেণ্যা নন। রাম নাকি দ্বাপরে কৃষ্ণের অবতার। তাই তার সাতখুন মাপ? এই রাম রাবণকে যুদ্ধে হারিয়ে বধ করবে বলে ধনুকভাঙা পণ করেছিল। মা দুর্গার স্তব করেছিল। আর শরতকালে দুর্গাপুজো করবে বলে দেবতাদের ঘুম পর্যন্ত ভাঙিয়েছিল অকালবোধন করে। রাম ঘরের সম্মান রাখতে পারলনা অথচ নিজের স্বার্থে দুর্গা নামে আরেক শক্তিশালী নারীর পুজো করতেও পিছপা হলনা! হায়রে! হিপোক্রেসি ভারতের ধর্মের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নিজের প্রয়োজনে এক নারীর পায়ে একশো আট পদ্ম দিয়ে পুজো হল অথচ রাবণ বধ করে সীতাকে লাভ করে অন্যের কথায় বৌকে ত্যাগ দিল! সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে বাল্মীকির আশ্রমে পাঠাতে যার একটুও বুক কাঁপলনা ! এ হেন রামের অয়ন অর্থাত গমন পথকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছিল আমাদের মহাকাব্য রামায়ণ। কিন্তু সীতার পাতাল প্রবেশ কিম্বা অগ্নিপরীক্ষা কি তাকে মনে রাখেনা? সীতা মাটির কন্যা আবার মাটিতেই মিশে গেছিলেন। তাই সীতায়ণ বা সীতার গমন পথও তো হতে পারত এই মহাকাব্যের নাম। মাটির কন্যা সীতা লাঙ্গলের ফলা বা "সীত" থেকে উঠে এসেছিলেন। আবার অত্যাচারে, লাঞ্ছনায় অতিষ্ঠ হয়ে বসুন্ধরার কোলেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাই নিজের জীবনচক্র তো নিজেই সমাপ্ত করলেন। রামকে এত প্যাম্পার করে, আদর্শের মুন্ডপাত করে হোক না সীতায়ণ!!! মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণও কিন্তু ব্যতিক্রম নয় । কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পান্ডবদের জেতানোর জন্য তিনি অনেক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। জারসন্ধ হত্যার জন্য ভীমকে ইঙ্গিত করা থেকে জয়দ্রথকে মারার চক্রান্ত করে আচমকা যুদ্ধক্ষেত্রে আঁধার ঘনিয়ে এনেছিলেন। তিথি নক্ষত্র না মেনেও সূর্যগ্রহণ ঘোষিত হয়েছিল। আমাদের কাছে শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু পুরুষোত্তম। টেলিভিশন খুললেই এখন বিদ্যা বালনের সেই মুখঝামটা? কনে বৌটির ছাতনাতলাতে মাথার কাপড় এক মুহূর্তের জন্য সরলেই ব্যস্! অথচ সেই গেঁয়ো কনে বৌ বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির বাইরে খোলামেলা লোকালয়ে যাবে শৌচকর্ম করতে! তার বেলা? হাইট অফ হিপোক্রেসি ! এভাবেই ভারতবর্ষ বেঁচে থেকে গেল রাম-সীতার আদর্শ আঁকড়ে, শ্রীকৃষ্ণের পরকীয়াকে ভীষণ ধর্ম, ধর্ম বলে। ধর্মের অনুশাসন বলছে "ডু হোয়াট আই সে, ডোন্ট ডু হোয়াট আই ডু"। অতএব ভীতু ভারতীয় মেনে নিল মুখ বন্ধ করে। বাড়িতে কন্যাসন্তানের জন্মের খবরটি সুসংবাদ বলে বিবেচিত হয়না আজো। পুত্রসন্তান হবার খবর এলে শাঁখ বাজিয়ে প্রচার করা হয় সেই শুভবার্তাটি। সেই কন্যারত্ন যখন দেবী লক্ষ্মী, সরস্বতী, কালী বা দুর্গা তখন কিন্তু মহাসমারোহে শঙ্খধ্বনিতে তাকে বরণ করা হয়। আজো গ্রামে গঞ্জে পুত্রসন্তানের অন্নপ্রাশনে ঘটা হয় কিন্তু কন্যাসন্তানকে কোনোক্রমে ঠাকুরবাড়ির প্রসাদান্ন মুখে দেওয়া হয় মুখেভাতের নিয়মরক্ষা করে। পুত্রসন্তানের জন্মদিনে পায়েসের বাটি-মাছের মুড়ো ঘটা করে তোলা হয়। আর মেয়েসন্তান বুঝি ইতুপুজোর ব্রতদাসী উমনো-ঝুমনোর মত দুর্ভাগা। গরীব বামুন বাপ তাদের পিঠে খেতে দেয়নি। বামনী যখন পিঠে ভাজছিল গন্ধ পেয়ে মেয়েদুটোর চোঁয়াপোড়া, কাঁচা-খরা পিঠে খাবার নোলায় দেওয়া হয়েছিল বনবাস স্বরূপ চরম ছ্যাঁকা । আবার সেই উমনোঝুমনো যখন ইতুদেবীর পুজো করে রাজরাণী হল তখন তাদের গরীব বাপ যেন তাদের পায়ে ধরে! কারণ তারা তখন বিত্তবান কন্যা, রাজার ঘরণী, বামুন বাপের মুখ উজ্জ্বলকারী কন্যাশ্রী। বাপ পারলে তখন মেয়েদের পুজো করে! আবারো এসে যায় জনস্বার্থে প্রচারিত বিদ্যাবালনের সেই বিজ্ঞাপনটি। প্রিয়ঙ্কা ভারতী নামে গ্রামের মেয়েটি তার স্বামীকে বলে কয়ে শৌচাগার বানায়। প্রিয়ঙ্কা এখন গাঁয়ের হিরোইন । বিয়ের রাতেই বেড়াল মেরেছে সে। শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়েই নতুন বৌ শান্তশিষ্ট স্বামী নামক গৃহপালিত জীবটিকে বশ করেছে দেখে তার শাশুড়িটির কি জ্বলুনি ভাবুনতো! টেলিভিশনে সেই কীর্তি দেখে জনৈক শহুরে শ্বশ্রূমাতা বললেন "ছিঃ, ছিঃ, বশীকরণ জানে মেয়েটা। আর বরটাও henpecked!থাকিস তো গাঁয়ে, বনেবাদাড়ে পটি করগে যা, তাই বলে বিয়ের রাতেই বরকে বশ করা!" আসলে শ্বশ্রুমাতাটি এতসব শোনাচ্ছিলেন তাঁর নবপরিণীতা বৌমাটিকে। পাছে তার ছেলেটি হাতছাড়া হয়ে না যায়। তাই বলে খোলা স্থানে শৌচকর্মের সাথেও নো কম্প্রোমাইজ।

উত্তরবঙ্গ সংবাদ রবিবার  

Monday, June 8, 2015

সিনান যাত্রা

 সিনান যাত্রা 

জগাদার ঘরের পাশেই বিমলিপিসির ঘর। একটু আড়ালে, একটু আবডালে।  খিড়কির দোর খুলে অবাধ যাতায়াত, অনায়াস গল্পগাছা, ফষ্টিনষ্টি  । সারাদিন জগাদার শৃঙ্গার, ভৃঙ্গার, ছাপ্পান্ন ভোগের  হুজ্জুতিতে বিমলিপিসির সাথে দেখা করার ফুরসতটুকুনি হয়না। 

বিমলি পিসি বলে বলে থকে গেল। চান করাতে পারবেনা তাকে। সেই সাথে তার ভাইবোনেদেরো। চান করতে বললে জগাদা রেগে আগুণ, তেলে বেগুণ।  এদিকে রোজ রাতেরবেলায় খিড়কির দোর খুলে বিমলিপিসির একটিবার না দেখা হলেও নয়। জগাদার ঘুম আসেনা। বিমলিপিসিও ছটফট করতে থাকেন। উড়িষ্যার ঐ প্রচন্ড দাবদাহে দিনের পর দিন, ঘন্টার পর ঘন্টা   জগাদা স্নান না করে গু-শুকনি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন লাঠিসোঁটা নিয়ে। শীতকালে না হয় রোজ স্নান না করলেও চলে। তারপর চৈত্র গিয়ে বোশেখ এলে জোর করে তাকে চন্দন যাত্রায় পাঠানো হয়। আবার একমাসের মধ্যেই প্রচন্ড গরমে হাঁসফাঁস। বিমলিপিসির মন মানেনা।

 রোজ রাতে বলেন
"শোনো নাগর, স্নান না করে আমার কাছে এলে গায়ে হাত দিতে দেবোনা, বলে দিলাম, অতএব পোস্কার ঝোষ্কার হয়ে এসো বাপু! একেই সারাদিনে শরীরে পচা জবাফুলের গন্ধে আমার ত্রাহি ত্রাহি ডাক। তারপর সিঁদুরের ঠেলায়, তেলে, জলে আমার শরীরটা শেষ। মেয়েরা আজকাল নিজেদের মাথায় সিঁদুর দেবেনা আর আমাকে পারলে সিঁদুরে চুবিয়ে রাখবে। সেই সাথে বেলপাতা, পদ্ম...ভক্তদের আদিখ্যেতায় আমি মরি আর কি!”

 সারাদিনের এই অত্যাচারের পর তিনি আসবেন চান না করে। এসেইমা বিমলা ওরফে আমাদের বিমলিপিসিকে  জড়িয়ে ধরবেন। সেই পেঁড়া-গুঁজিয়ার মুখেই চকাস চকাস করে পটাপট চুমু খাবেন।  কি দুর্গন্ধ মুখে! সেই কোন সকালে একবার নিমের দাঁতন বুলিয়ে নিয়েছেন দাঁতে। না টুথপেষ্ট না মাউথওয়াশ। আর সারাদিন ধরে চলছে তার ছাপ্পান্ন রকমের মিষ্টি গেলা।

"আমার  হাতদুটোতো নেই, জানো বিমলা। আমি তো ঠুঁটো হয়েই রয়ে গেলাম। একটু তাই আমার মুখ সর্বস্ব চেহারাটা দিয়েই না হয় তোমাকে সারাদিনের শেষে পেতে চাই। তাতে এত কথা? ঠিক আছে যাও, কাল থেকে আর রাতে আসব না তোমার সাথে দেখা করতে।" জগাদা বলল 
বিমলা বলে, "আহা, রাগ কচ্চো কেন নাগর? আমি কি আসতে বারণ করলাম? আমি তো তোমাকে একটু  স্নান করে আসতে বলছি শুধু! আমার যে এই গরমে বড্ড ঘেন্না করে। তুমি তো জানো সারাদিন আমিও অপেক্ষা করে থাকি এই রাতটুকুর জন্যে, উড়িষ্যায় একেই গরম আর এখানেই তুমি সহজসঙ্গী, আমার প্রাণের ভৈরব "  
"ঠিক আছে, কথা দিলাম বিমলা, ভৈরবী আমার। এবার থেকে স্নান না করে তোমার কাছে আর আসব না "

বিমলা একগাল হেসে নাকে গামছা   বেঁধে বললেন, "একটু তফাতে যাও। আগে স্নান করো, তারপর কাছে আসবে।"
জগাদা ঘষ্টে ঘষ্টে সরে গিয়ে দাঁড়ালেন, একটু মনক্ষুণ্ণ হলেনো বটে! 

"মনে আছে মিন্‌সে? জৈষ্ঠ্যমাসের পূর্ণিমা আসছে, তোমার হ্যাপি বার্থডে"  বিমলিপিসি বললেন কিঞ্চিত ধমকের সুরে । বছরে ঐ একটাদিন  তুমি সম্বচ্ছরের স্নান করবে ;  চন্দন, অগুরু আর ১০৮ কলসের জল ঢালা হবে, তোমার মাথায়। সেই সাথে তোমার দামড়া দাদাটা আর ছোট বোনটার মাথাতেও।  ঐ জম্মের বুড়ি কম্ম! একদিনে বহু স্নান! বুঝি না কি আর? সব লোক দেখানো। সব প্রাপ্তিযোগের আশায়। তার চেয়ে বাবা আমি রোজ দু-মগ গায়ে ঢালি। আমার দরকার নেই অমন স্নানে।"
জগাদা আর থাকতে না পেরে বললেন, "আহা আমাদের তিন ভাইবোনের কি আর তোমার মত সোনার অঙ্গ? আমরা তো দারুব্রহ্ম, জানোতো তুমি! এসব পুরোণো কাসুন্দি ঘেঁটে কি লাভ তোমার?"
"দারুব্রহ্ম না হাতি! গর্ভগৃহে  কাঠের পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোজ রাতে একটু আধটু দারুও চলে তোমাদের। সে কি আর জানিনা ভাবো?"
"নাগো বিমলা, না। আমরা খাইনা। বলুদাদা খায় শুধু। আমারা ঘুমিয়ে পড়ি গল্প করতে করতে। তারপর দাদা আর বোন ঘুমোলেই আমি টুক করে চুপিচুপি তোমার কাছে চলে যাই" 
  "তোমাদের এই  বার্ষিক স্নানকৃত্যর অদিখ্যেতা দেখলে আমার যে কি হাসি পায় বাপু !“
একপাল লোকের সামনে দিয়ে স্নান করতে যাবে চারজনে মিলে। তোমরা তিন ভাইবোন আর সুদর্শন। খোলা স্নানবেদীতে দাঁড়াবে চারজনে। আর অতজোড়া চর্মচক্ষু গিলবে তোমাদের্! তোমাদের আর কি! ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়!  তোমার শুভ জম্মোদিন বলে কতা! রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন কি চালাকই না ছিলেন! সারাবছরের ঐ একটি দিনে মন্দিরের তহবিলে বেশ ভালোরকম আমদানী হয়। নাম দিয়ে বসলেন, চন্দন যাত্রা, স্নান যাত্রা, রথযাত্রা, দোলযাত্রা .. " বিমলা বলল।

তারপর একশো আট কলসীর পুণ্যজল, শুভজল, ভালো জল, পবিত্র জল,  বিশুদ্ধ জল সব একে একে তোমাদের মাথা থেকে সর্বাঙ্গে ঢালা হয়। সুকুমার রায়ের অবাক জলপানের মত যেন অবাক জলস্নান! তারপর সকলে পরবে হাতির মুখোশ। একে বলে গজবেশ। গণেশকে একটু মান্যি করলে আরকি! বিমলিপিসির  কোলের ঐ ছেলেটার পুজো না হলে কোনো শুভ কাজ হয়না যে ।
তারপর বাবুদের জ্বর আসবে। সত্যি সত্যি আসবে কি না জানিনা, তবে জ্বরের ভান করে, জরজর থরথর অঙ্গ নিয়ে  চারমূর্তি মচ্ছিভঙ্গ হয়ে পড়ে থাকবে ঘরের কোণে।
"পূর্ণিমার তিথিতে অমন ভয়ানক স্নান করলে জ্বর আসবেনা? একে প্রবল তিথি তায় আবার সম্বচ্ছরি স্নান! ব্যথায় বেদনায় কাবু তো হবই"...  জগাদার গলায় অভিমানী সুর। রোজ রোজ স্নান করতে দেবেনা, কাঠের শরীর ক্ষয়ে যাবে বলে। আর যেদিন স্নান করাবে সেদিন এমন স্নান করাবে যে তেড়ে জ্বর এসে যাবে আমাদের্! মা বলতেন" তাত সয় তো বাত সয়না!"  আমি বাপু তাই এই এত জলটলে স্নান করতে নারাজ। 

 তোমাদের আবার প্যারাসিটামল চলেনা!   তারপর রাজবৈদ্য আসবে। এই সময় কেউ তাদের মুখ দেখবেনা। তারপর রাজবৈদ্যের প্রেসক্রিপশান অনুযায়ী এক আয়ুর্বেদিক পাঁচন প্রস্তুত হবে।  এক পক্ষকাল সেই পাঁচন খেয়ে তেনারা জ্বর থেকে মুক্তি পাবেন!   "অনসর" বলে এই সময়টাকে।  বিমলিপিসি বললেন । 

স্নানযাত্রা কাটতে না কাটতেই রথযাত্রা বাম্পার মোচ্ছব! শুধু ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকলেই হবে?  পেজ থ্রি কাঁপাও জগাদা তিন ভাই-বোনে মিলে। বোল্ড এন্ড বিউটিফুল সুভদ্দোরার বেদিং বিউটি পাবলিক গিলবে খুব। লুফে নেবে প্রিন্ট মিডিয়া। তোমার হান্ডি উপচে পড়বে..  প্রচুর এড পাবে এই স্নানযাত্রা মহাযজ্ঞে।    যাও জগাদা, বিমলিপিসিকে নিয়ে একটা সেলফি তুলে ফেসবুকে পোষ্টাও। উড়িষ্যা তথা সারাদেশের ব্র্যান্ড এমবাস্যাডার তুমি। নিজের ব্যান্ড নিজেই বাজাওগে। স্নানযাত্রার আগের রাতেই পাবলিককে স্টেটাস আপডেট করে জানিয়ে দাও "আগামীকাল আমাদের মহাস্নান, অল আর ওয়েলকাম! একবার ছেড়ে দিলে সোনার গৌর আর তো পাবেনা! অতএব শুভস্য শীঘ্রম্‌!"

(কলকাতা -২৪x৭)  

Sunday, June 7, 2015

কৃপা করো FMCG রে


ভোর হল, টিভি খোল, ছেলে বুড়ো জাগো রে
ঐ ডাকে এড-মামা, কেনাকাটি শুরু রে!
সকাল হলেই দাঁতমাজা দিয়ে শুরু হোক ভোর তোমার । ভোরের আলো দুচোখে মাখতে মাখতে চেয়ে দেখ কত্ত সব আয়োজন তোমার বত্রিশ পাটির সুরক্ষার ও সুগন্ধের জন্য । পর্দার একপাশে বাবু একপাশে বাবা । পারলে যতবার খাও ততবার দাঁত পালিশ করো । কেউ বলছে এই মাজন তো কেউ বলছে ওই । কোনটায় দাঁত হবে লোহার মত শক্ত, কোনটায় পাথর । সেই ঠাকুমার ঝুলির গল্পের মত লোহার কড়াই কড়মড় করে চিবিয়ে খেতে পারবে তুমি ! এক্সট্রা শাইনের জন্য আর একটু পয়সা বেশি দিলে পাবে নোনতা মাজন । দাঁত-পালিশের পর গা-পালিশ । আছে স্নানের সময় গায়ে মাখার জন্য সৌন্দর্য-বার সাবান, পরিচ্ছন্ন-কেক সাবান, দীপ্তিময়-লাবণ্যের প্রতিশ্রুতি বদ্ধ আরো সাবান ; সোনার চেয়েও সোনা হবে ত্বক ! সোনার চেয়েও দামী হবে তুমি ! গোল্ডলাইট কালেকশানের মত হালকা ফুরফুরে হবে তুমি । তারপর ফেসওয়াশ, বডিওয়াশ, হ্যান্ডওয়াশ । সাবান ! তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে ! এক সাবানের কত রূপ ! এক কার্বনের কত বহুরূপতার মত । কখনো হীরে, কখনো চারকোল, কখনো আবার ভুসোকালি । পারলে গেয়ে ওঠ "এক‌ই অঙ্গে এত রূপ দেখিনি তো আগে" !
এবার কেশ পরিচর্যার ঘটা । হেয়ার ফল এক্সপার্ট থেকে হেয়ার কালার এক্সপার্ট । হেয়ার শাইন এক্সপার্ট থেকে ড্যানড্রাফ এক্সপার্ট সকলেই আছেন এক আকাশের নীচে । শুধু তুমি আছ ওপারে । মাথার যে চুল এতদিন তোমার বশে ছিল, সে এখন চুল এক্সপার্টের কারসাজিতে তোমার স্ক্যাল্পে প্রাণ খুলে তাথৈ নৃত্য করছে । চুল যেন চুল নয়, শীতের হাওয়ায় দমকে দমকে দোলালাগা ধানগাছ!
স্নানসেরে এবার ত্বক-পালিশ !হরেক কিসিমের ক্রিম থরেথরে সাজানো শুধু তোমার জন্য ! শুধু তোমার কেনার অপেক্ষায়! ত্বকে কালো ছোপ তোলার ক্রিম, কালো স্পট তোলার স্পেশাল ক্রিম , চোখের কালি পোঁছার ক্রিম, ফর্সা হবার ক্রিম এমন কি চাকরী পাবার ক্রিম । ফল খেওনা, বড্ড দাম যে ! তার চেয়ে ফল চটকে ক্রিমে দেওয়া হচ্ছে যা রোজ মাখলে প্রিয়তম একদম ফিদা । ফলের নির্যাস, নামীদামী বাদামের তেল, ডিমের কুসুম, ডাবের জল, গোলাপের পাপড়ি, কমলালেবুর খোসা কি নেই এতে ? পাকাপেঁপে থেকে শসা , পিচ থেকে জলপাই সব মাগ্যির ফল আছে এই সব ক্রিমে । সকাল সন্ধ্যে ঠাকুরের সামনে এক কৌটো ক্রিম রেখে দাও আর মাঝে মাঝে একখাবলা তার থেকে নিয়ে মুখে মেখে নাও । আহার ওষুধ দুইই হবে । একে নৈবেদ্য তাতে তেলতেলে ক্রিম ! ভগবানও খুশ আর তুম ভি ! নিজেকে একবার দেখে গেয়ে উঠবে " একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ এসো হে"
মেয়েরা ক্রিম মেখে আসছে যুগ যুগ ধরে আর ছেলেরা কি চেয়ে চেয়ে দেখবে ? মুখ তুলে চেয়েছেন ভগবান । ফেয়ারনেস ক্রিমের যাদুতে আজকাল নাকি ছেলেদের চাকরীও মিলছে । কে বলেছে রিসেশন ?কে বলেছে ভাল কলেজে না পড়লে ভাল প্লেসমেন্ট হয় না ? ফর্সা হলে চাকরী অবধারিত।
এড আসে এড যায়, ক্রেতা টিভি পর্দায়
ঝক্কাস বকবাস, ক্রেতাকুল বিন্দাস !
এবার গিয়ে বস ব্রেকফাস্ট টেবিলে । পাশে খবরের কাগজ খোলা আর সামনে খোলা টিভি । সুতরাং আবার কর্ণ এবং চিত্তশুদ্ধির ধারা অব্যাহত ।
তর্কের তুফান তোল গিন্নীর সাথে । মনের খচখচানি; মাখন না মার্জারিন? কোনটায় বিদ্ধ হবে পাঁউরুটির শাণিত তরবারি?
আবার যুক্তির ফুলকি এসে পড়ল টেবিল-চাদরে "কোন‌ তেলে ভাজা হবে প্রাণের অমলেট খানি ?" সূর্যমুখী, সয়াবিন না কি রাইসব্র্যান অয়েল "? কেউ বলে পুফা, কেউ বলে মুফা, কেউ বলে দুইই ! পুফা ও মুফা নিক্তির ওজনে থাকলে তোমার হৃদয়ের "লাব-ডাব"এ হবে ফাইন টিউনিং ! হৃদয়ের কলিজা ওরফে অর্ধাঙ্গিনী কাছে এলেই শুনতে পাবে তোমার দিল কি ধড়কন ! তুমি মিষ্টি হেসে গাইবে "আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে" কিম্বা গিন্নী গাইবেন "আমার এই দেহখানি তুলে ধর" শক্তিমানের মত !
দুঃখের যজ্ঞ অনল জ্বলনে ব্রেড-অমলেটের আহুতি দিয়ে এবার অফিস । গিন্নি ততক্ষণে কাজের লোকের হাতেহাতে এগিয়ে দিচ্ছেন ঘরমোছার হলদে বোতল, ঘর পরিষ্কারের সবুজ বোতল, ঘরকে জীবাণু মুক্ত করার সাদা বোতল । কাপড়কাচার জন্য লেবুর শক্তিওলা ডিটারজেন্ট, গোলাপের গন্ধ , জুঁইফুলের গন্ধ ওলা হাতের বন্ধু সাবান গুঁড়ো । রঙীন জামাকাপড়ের জন্য এক , সাদার জন্য আর এক । শুধু কৃপা করো এফএমসিজি রে ! বিদ্যুতের ঝলকানি চলে যায় সাদা শার্টের বুকের ওপর দিয়ে; সেই হঠাত আলোর ঝলকানি লেগে দর্শক কাম ক্রেতার ঝলমল করে চিত্ত ;
টু'মিনিটের ম্যাজিক-মশালায় সারাদেশের মানুষ আজ নুডলসের বশে ! লাঞ্চবক্সে , ডিনারে , জ্বর হলে , অতিথি আপ্যায়নে , ক্ষুধাতাড়নায়, গৃহিনীর সুবিধার্থে নুডলস । নুডলসের খালি প্যাকেট আপনি পেয়ে যাবেন বদ্রীনাথ আশ্রমের সংলগ্ন পাহাড়ে কিম্বা দশম ফলসের ঝোরার জলেও । এ যেন বন থেকে বেরোলো এক্কেবারে সোনার টোপর মাথায় দিয়ে ! ভিনি, ভিডি, ভিসি ! রাতারাতি নুডলস দুনিয়ায় সেলিব্রিটি । ছেলেবুড়ো সকলের স্টেপল ফুড । চিন্তা করা যায় ? মিড ডে মিলে নুডলস চালু হল বলে !
অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হয় কি রাঁধি? চোখের সামনে ম্যাজিক মাংসের মশালা । শুধু মেশান, মাখুন আর জমিয়ে দিন । সারাদিন পর বাড়ি ফিরে নিজের ছেলেকে দেখে মনে হল কিস্স্যু খায় না, তখনই স্বাস্থ্যসম্মত হেল্থ ড্রিংক ফুরফুর করে ভেসে উঠল পর্দায় । একটা জাম্বো ডিবের মধ্যে সব ক'টি প্রয়োজনীয় উপাদান ভর্তি করে সীল করে দেওয়া আছে সোনামনির জন্যে । এ স্বাস্থ্যপানীয় বেঁটে বাচ্ছাকে লম্বা করে, বোকাকে বুদ্ধি দান করে আর দুর্বলকে সবল করে । পরক্ষণেই আর একজন বলছে যারা অঙ্ক পারেনা, যারা পড়া ভুলে যায় তারা খাবে আগের পানীয়টির এম + + অর্থাত ম্যাথস + এবং মেমারী + । বুঝে নিতে হবে তোমাকে, দাম দিতে হবে তোমাকে । আছে গর্ভবতী মায়ের জন্য, পরিশ্রমী গৃহকর্ত্তার জন্য, হাড় ও বাতের ব্যাথায় কাতর গৃহবধূটির জন্য একদম কাস্টমাইজড হেলথ ড্রিংক । মা বাড়ি আসামাত্রই ছেলের অভিযোগ, সাইকেল থেকে তার পা কেন মাটি অবধি পৌঁছায় না ? গাছের আম কেন ধরা দেয় না তাকে ? মা যারপরনাই চিন্তায় । পরক্ষণেই প্রবলেম সলভড । তাকে এনে দিলেন সেই ম্যাজিক প্ল্যান্ড-হেল্থ ডিঙ্ক ।
এদিকে মামি বলে নুডলস, টামি বলে স্যুপ! টানাপোড়েনে জর্জরিত বালক পড়ার ঘর থেকে উঁকি মারে টিভির পর্দায় ; হয়তবা শচীনের হাতে সই করা ব্যাটের লোভে কিনতে চায় কিছু কিম্বা ওয়ার্ল্ডকাপের টিকিট পাবার আশায় মরীচিকার পেছনে ছুটে যায় পাশের ঘরে আর বলে "বাবা, এটা দেবে কিনে"
মা ততক্ষণে বালকের সামনে সুদৃশ্য বোল নিয়ে হাজির তিব্বতী থুক্‌পা নিয়ে !
তারপরই বীজানু শূন্য জল পাবার উপায় । দেখতেই হবে মন দিয়ে সেই কবে স্বাস্থ্য ব‌ইতে পড়েছিলে না ? "জলই জীবন"
কাদাগোলা একগ্লাস জলের মধ্যে দিয়ে সোঁ সোঁ করে অতিবেগুনী রশ্মে গিয়ে সব পোকা মেরে দিল নিমেষের মধ্যে আর তুমি পেলে এক গ্লাস স্ফটিক স্বচ্ছ জল । সাথে সাথেই অন্য একজন বলল " মিথ্যে কথা " বিশুদ্ধ জল আমি দেব । আমি ভাই অত শত বিজ্ঞান বুঝিনা । কার কথা শুনব ? আবার কন্ট্রোভার্সি । আর সাথে সাথে অবাক জলপান !
তার সাথে আছে শহরের আনাচকানাচের বিউটিশিয়ানদের ব্যয়বহুল বাক্যি । তাদের প্রতেকের স্ব স্ব ব্র্যান্ড । বাক্সের এপারের নীরব দর্শক হয়ে আমি ভাবি "সেই ভালো সেই ভালো, আমারে না হয় না জানো, সেই ভালো সেই ভালো " কত অভিজ্ঞ এই রূপবিশারদেরা ! আমারে তুমি অশেষ করেছ । আর নয় । আমার নাই বা হ'ল পারে যাওয়া । মাঝে নদী বহে রে । ওপারে তুমি রাধে এপারে আমি । ক্ষতি কি ! আমি তো আর রিয়েলিটি শোতে যাব না । ডিম খেও না, কোলেস্টেরল বাড়বে । তার চেয়ে মাথায় মেখে ফেল কুসুম আর গালে ডিমের সাদা ! যেমন হবে কেশ তেমন হবে ত্বক ! বললেন বিউটিদি বা রূপোলীপর্দার রূপসীদি । পরক্ষণেই দেশের ডিম-কোঅর্ডিনেশন কমিটি এসে বলল রোজ একটি করে ডিম খেতে । তাহলে শচীনের মত হাট্টে-গাট্টে হবে । তোমার হাতের কবজী হবে ভূপতি-পেজের মত । এদিকে বাক্সের এপারে আমার অবস্থা আমার শেষ পারাণের কড়ি দিয়ে কি কিনি ? আগে ডিম না আগে ক্রিম ?
যে যত ঢাক পেটায় তার তত ব্যবসা । আরে বাবা আমাদের দেশটা আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেবে কি করে নয়ত ! তিনহাজার কোটি সন্তানের ভারত আমার ভারতবর্ষ । বিজ্ঞাপন! তুমি না করিলে কে আর করিবে এদেশের উদ্ধার ?
চোখ মেলে দেখ । এত জিনিষপত্র বিক্রি হচ্ছে ঐ তিনহাজার কোটি দর্শকের তিনশো টিভি চ্যানেলে । তুমি না কিনিলে কি করিয়া দেশ হ‌ইবে শাইনিং !
এই তো চাই ! উত্তিষ্ঠিত ক্রেতাগণ! জাগ্রত ক্রেতাগণ !
বোকাবাক্সে চোখ মেলে থাক ।
ভারতবর্ষের আজ সুদিন এসেছে ।
যাই দেখি, কে আবার বাজায় বাঁশি আমার ঐ টিভির স্ক্রীনে!!! 

উত্তরবঙ্গ সংবাদ রবিবার   

জামা-e-ষষ্ঠী


জামা-e-ষষ্ঠী 
 
জামাইষষ্ঠীর আরেক নাম অরণ্য ষষ্ঠী। কি এবং কেন অনুধাবন করতে গিয়ে জানতে পারলাম বাংলার এই ব্রতের কারণ। এক বুড়ির একপাল ছেলের মধ্যে (ভাগ্যিস! ফ্যামিলি প্ল্যানিং ছিলনা) ছোটবৌটির খুব মিথ্যে বলার অভ্যাস। নিজে চুরি করে খায় আর রোজ রোজ একটি পোষা কালোবিড়ালির নামে দোষ দেয়। কালোবিড়ালি মা'ষষ্ঠীর বাহন। সে গিয়ে নালিশ করলে মা ষষ্ঠী ছোটবৌ'কে শাস্তি দেবার কথা ভাবেন। ছোটবৌ ফুটফুটে পুত্র সন্তান প্রসব করে আর কালোবিড়ালি সেই সন্তান মুখে করে নিয়ে রেখে আসে বনে জঙ্গলে। এইভাবে একে একে ছোটবৌ গোটা সাতবার গর্ভ ধারণ করে পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় আর সব কটি পুত্র কালোবিড়ালির খপ্পরে পড়ে । এবার ছোটবৌ কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। কিন্তু সেই প্রসবটি হল সকলের অলক্ষ্যে, জঙ্গলের মধ্যে। কিন্তু তবুও কালোবিড়ালির চোখ এড়ালোনা। মানে যাকে বলে বুলি করা। সে যথারীতি মুখে করে রেখে এল কন্যাশিশুটিকে। তখন ছোটবৌ আর না পেরে মা ষষ্ঠীকে ডাকতে লাগল। তিনি এদিকে আগের সেই সাতটি পুত্র ও আর এক কন্যাকে লালন করতে শুরু করেছেন। ছোটবৌকে শিক্ষা দেবার জন্য তাকে বললেন" তুমি অন্যের নামে মিথ্যে অপবাদ দিয়েছিলে বলে ঐ কালোবিড়ালি রাগ করে তোমার সবকটি সন্তানকে আমার কাছে রেখে গেছে। তুমি তার পায়ে ধরে ক্ষমা চাও তবে সকলকে ফিরে পাবে" ছোটবৌ কালোবিড়ালিকে আদর করে ডেকে এনে তাকে মাছ-দুধ খাইয়ে তুষ্ট করলে আর ক্ষমা চেয়ে বললে তার সন্তানদের ফিরিয়ে দিতে। কালোবিড়ালি বললে" জৈষ্ঠ্যমাসের শুক্লপক্ষে ষষ্ঠীর পুজো করো। তোমার সন্তানরা সকলে সুস্থ থাকবে আর মা ষষ্ঠী সকলকে ফিরিয়ে দেবেন।"
মনোবৈজ্ঞানিক দাওয়াই দিতে সিদ্ধহস্ত ষষ্ঠীবুড়ি। অন্য দেবদেবীর ভীড়ে নিজের ব্র্যান্ডটা যাতে ডাইলুট না হয়ে যায় ! আর কালোবিড়ালি হল মা ষষ্ঠীর এজেন্ট।
তদ্দিনে টাইম ট্র্যাভেলের কৃপায় ছোটবৌয়ের সাতছেলে-সাতবৌ আর কন্যা সহ একটি জামাই নিয়ে ভরভরন্ত সংসার। মা ষষ্ঠীর অরণ্যের ঘেরাটোপে ছেলেপুলে গুলি বেঁচেবর্তে ছিল বলে অরণ্যষষ্ঠী নাম এর। আর ছেলে-বৌ-মেয়ে-জামাই সকলের মঙ্গল কামনা করেই এই ষষ্ঠী। এবার আসি মূল ব্রতের নীতিকথায়......
) বৌ-রাই কি আদি অনন্তকাল ধরে মিথ্যে কথা বলে???
) তখনকার দিনে বৌদের কম কম খেতে দেওয়া হত বলে সে রান্নাঘর থেকে খাবার চুরি করে খেত, তার জন্যে তাকে বারবার গর্ভাধানের মাশুল দিয়ে শেষে ক্ষমা চাইতে হবে?
) সাত-সাতটি পুত্র সন্তান হাপিশ হবার পরেও বৌয়ের টনক নড়লনা? শেষে মেয়েটা হারাণোর পর ছোটবৌ মা ষষ্ঠীর কাছে আর্জি জানালো? অতএব সেখানেই কন্যাসন্তানের জয়! আর ছেলে-বৌ দের সাথে মেয়ে-জামাইয়ের জন্য ফল-বাটা ইত্যাদি দেবার প্রচলন আছে এই ষষ্ঠীতে
তাই আজকের দিনে কুদোস টু ষষ্ঠীবুড়ি! জয় অরণ্যষষ্ঠীর জয়! জয় জামাইষষ্ঠীর জয়! জয় বৌষষ্ঠীর জয়!
সেই থেকে শহর জুড়ে জামাইষষ্ঠী পালন শুরু। তবে এখন ইলেকট্রনিক জামা-e-ষষ্ঠীর যুগ এয়েচে। নেই সে জামাই, নেই সে অরণ্য।
জামাইবুড়ো ষষ্ঠী খেতে চাইলেই তো হবেনা। সেই শুনে বুড়ো শ্বশুরের কষ্টিপাথর টাকের্ ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম। ছাতা মাথায়, যষ্টি হাতে জ্যৈষ্ঠের অসহ্য গরমে শ্বশুর আম-লিচু-কালোজাম খোঁজেন আর মনে মনে জামাই বাবাজীবনের গুষ্টির তুষ্টি করেন। বাড়ি ফিরে গিন্নীকে বলেন, এবছরেই লাষ্ট ষষ্ঠী কিন্তু, এই বলে দিলুম। বাটা দেবেন গিন্নী!একটা না দুটো না পাঁচটা ফল চাই। আবার গিন্নীর অনুরোধ একটা একফুট লম্বা কাঁঠাল চাই। শুধু তো আর ফল কিনলে হবেনা। ফলের সাথে চাই পল অর্থাত মাংস। পলের পরেই পোলাও। চাই বাসমতী চাল। মনে মনে কর্তা বলেন, পরের ছেলের জন্যে দরদ উথলে উঠচে। নিজেরা কোনোদিন বাসমতী খেলামনা। গিন্নী সেই শুনে বললেন, ভালোই তো, কথাতেই তো আছে, জামাইয়ের জন্যে মারি হাঁস। গুষ্টিশুদ্ধ খায় মাস। আমি না হয় "জামাইয়ের জন্যে রাঁধব বাসমতী, গুষ্টিশুদ্ধ খেয়ে করবে ফূর্তি"
পলের সাথে চাই জল অর্থাত ঠান্ডা নরম পানীয়। জলের পরেই পান।
ওদিকে জামাই ভাবে গুষ্টিশুদ্ধ শালাশালীর জন্যে । খুব চিন্তা হয়। একটা দিনে পকেট খালি হবার যোগাড়। এমনি হয়ে আসছে বিয়ের পরের বছর থেকেই।
এবছর জামাই হঠাত করে ট্রান্সফার হয়ে গেল বিদেশে। খুব খুশি শ্বশুর।
জামাইষষ্ঠীর আগের রাতে এপারে গুষ্টিশুদ্ধ শালাশালী আর শ্বশ্রুমাতা আর ওপারে জামাই একা তুষ্টি খুঁজে জামাইষষ্ঠীর। মাঝে একরাশ ডিজিটাল ঢেউ। স্কাইপ কল অন।
সৃষ্টিছাড়া জামাইবুড়ো তুষ্টি খোঁজে নেটে, মিষ্টি হেসে শ্বশ্রূমাতা ওয়েবক্যামে সেঁটে ।
জামাই বলে মিস করছি খুব।
শ্বশ্রূমাতা পষ্টাপষ্টি মেসেজ দিয়ে খালাস, আগুণ বাজার e-ষষ্ঠী, বাতিল তত্ত্ব-তালাস ।

শালাশালির সাথে ফষ্টিনষ্টি হয়। জামাইবাবুর খরচা বাঁচে । ভুঁড়িটা আনন্দে ফুলে উঠে জয়ঢাক ।
গুষ্টি শুদ্ধ অনলাইনে চটরপটর চ্যাট, জামা-e-ষষ্ঠী তর্ক বৃষ্টি বকর বকম্‌ ভাট ।
হঠাত বলে জামাইশালা,
শুকনো হাসি জামাই-বিদেয় মানছিনা, মানব না, বের করুন ক্রেডিট কার্ড, খুলে ফেলুন খাপ। নম্বরটা দিন আমারে, পাঞ্চ করব আমি, পাসওয়ার্ডো দেবেন সাথে। শালী-শালা, শ্বশুর শাশুড়ি সব মুখ চাওয়াচাউয়ি করে।
ইচ্ছেমত ষষ্ঠীবাজার করে নেব নেটে..
বেশী কিছু নয় !

ঘড়ি, জামা, জুতো, খাবার সবি ঘেঁটে পাবো
দরকার মত ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিও পাবো।
প্রয়োজনে অনলাইনে খাবারো অর্ডার দেব।
খেয়েদেয়ে বুক-মাই-শো মুভি টিকিট নেব।
উবের-ওলা ক্যাব ডেকে মাঞ্জা দিয়ে যাব। 

উত্তরবঙ্গ সংবাদ  শ্রীমতী শনিবার 

"মেঘ-মেল"

আটলান্টার পুজো ম্যাগাজিন "অঞ্জলি"২০১০ এ প্রকাশিত রম্য রচনা


মেঘ-মেল

গল্পের নায়ক যীশু একজন বিরহী যক্ষ । সে সফট্‌ওয়ার কনসালটেন্ট। বছরের মধ্যে তিনভাগ থাকে দেশের বাইরে আর একভাগ থাকে তার হোমটাউন আলিপুরের অলকাপুরীতে। সবেমাত্র বিয়ে করেছে অনন্যাকে। বিয়ের পর প্রথম বর্ষা অনন্যাকে ছাড়া যীশু ভাবতে পারছে না, তাই মেঘের উদ্দেশ্যে তার এই মেল লেখা।

পূর্বমেঘ

"মেঘ", এবারের বরষা আমার জীবনে অভিশাপ । আমি জানিনা তোমার এবারের গতিপথ, জানিনা তোমার ট্রাভেল-আইটিনারি। কোলকাতায় "মেঘমৌসুমী" তুমি হাজির হওয়া মাত্রই আমায় সঙ্কেত দিও। আলিপুরের অলকাপুরীতে আমার প্রিয়া অনন্যা অপেক্ষমানা। সে আমার শোকে কাতর কিনা জানিনা তবে আমি তার বিরহে বড় কষ্টে আছি। তাকে বোলো গিয়ে একটিবার, যে সকল প্রোষিতভর্তৃকারাই এরূপে আছে, তাদের সকলের স্বামীও শীঘ্র ফিরবে । সে যেন মন খারাপ না করে।"মেঘ", উদাসী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমিবায়ুর আনুকুল্যে ভেসে চলেছ তুমি ; পথে শুনবে দলে দলে চাতকের সুখ শ্রাব্য বর্ষা মঙ্গল, নববর্ষার আগমনী বার্তা তুমি ঘোষণা করবে তোমার গুরু গুরু গর্জন দিয়ে। উত্সুক রাজহংসেরা নবকিশলয়ের মত গ্র্রীবা উঁচিয়ে তোমাকে অভিবাদন করবে। শোন মেঘ, আমার প্রিয়াকে অভিবাদন কোরো তোমার শিলাবৃষ্টি দিয়ে, মুছিয়ে দিও তার উষ্ণ অশ্রুবিন্দু আর তাকে শুনিও আমাদের দুজনার সম্ভাব্য মিলনগান, রবিঠাকুরের গানই শুনিও পারলে, "এমন দিনে তারে বলা যায়" অথবা "আজি ঝরঝর মুখর বাদরদিনে" । শ্রান্ত হলে পাহাড়ের ঢালে পা ফেলে জিরিয়ে নিও, পিছলে পড়ে অন্যকোথাও চলে যেও না, তাহলেই কোলকাতায় পৌঁছান হবেনা তোমার । নদীর জল পান কোরোনা যেন জন্ডিস হতে পারে । মিনারাল ওয়াটার সাথে রেখ।গরমে বাইরের খাবারই তোমার খেতে হবে । হলদিয়া বন্দর হয়ে, ডায়মন্ডহারবারের দিক দিয়ে, রায়চকের রেসর্টে দুদন্ড জিরিয়ে নিও; তারপর দক্ষিণ কোলকাতার সাউথসিটিমলের মাথায় ধাক্কা না খেয়ে ভেতরে গিয়ে ফুডকোর্টে একটা ধোসা আর একটু হিমশীতল টকদৈ খেও | যদি পেটে জায়গা থাকে তবে আইসক্রিম খেতে পারো । যা খাবে সব কিছুই যাতে তোমায় ঠান্ডা রাখে দেখো। আমপান্না, লস্যি এজাতীয় পানীয়ই তোমার পক্ষে আদর্শ এখন । হাজরা পার্কে ফুচকা খেও খুব সুস্বাদু ! তবে দেখো যেন মিনারাল ওয়াটারে বানায় । দূষণ এখন কোলকাতার ভূষণ তাই চমকে উঠনা । নিজেকে বাঁচিয়ে রেখ একটু, শুকিয়ে যেও না যেন । উর্বর কোরো কৃষিভূমি আর কোলকাতায় মাত্রাতিরিক্ত জলবর্ষণ করোনা যেন, তাহলে অনন্যার মত সকল প্রোষিতভর্তৃকাদের জলমগ্ন হয়ে কালাতিবাহিত করতে হবে ।

উত্তরমেঘ

আলিপুরের প্রাসাদোপম অলকাপুরী এপার্টমেন্টের টপফ্লোরে আমার ফ্ল্যাট । দেখো গিয়ে অনন্যা বোধ হয় বাড়ি থাকেনা সব সময় । তবে কোনো একটা শপিংমলে তাকে তুমি পেয়ে যাবে নিশ্চয়‌ই । শোনো মেঘ, তুমি উড়ে গিয়ে দেখ একটিবার কোথায় আমার অনন্যা? কার কন্ঠলগ্না হয়ে কোন ক্লাবে বসে আছে নাকি বক্ষলগ্না হয়ে ডিস্কোথেকে, তন্ত্রে মন্ত্রে মেতে আছে ! আমার সাথে তার যোগাযোগ বিছিন্ন, মেলের উত্তর দিচ্ছেনা নেট খারাপ বোধ হয়, ট্যুইয়াটেরো বহুদিন ট্যুইট নেই, অর্কুটের আইডি ডিলিট করেছে, জি-টকেও আসে না আজকাল। সেল ফোনটা সব সময় ব্যস্ত তার |

কি জানি অনন্যা এখন বসে আছে যোগাসনে না জিমনেসিয়ামে ! নাকি কোনো বিউটিস্যালনে অথবা মায়া নাকি ছায়া সুশীতল কোনো ক্লিনিকে কুড়চি-কদম্ব-কেতকী প্রলম্বিত স্পা এর অবগাহনে অলকাপুরীর বেডরুমে তো সর্বদা শীর্ষাসনে থাকত সে, মেদশূন্যতার আশায় । যাবার সময় তার জন্য কিছু টাটকা কচি শশা অথবা অমৃততুম্বী এবং মেদনিবারক পাকা পেঁপে নিয়ে যেও অনন্যা আমার আর কিছুই খায়না সাথে সুশীতল বরফকুচি দিও তাকে, তার প্রসাধনে কাজে লাগবে তোমাকে এককপি ছবি এটাচ করে দিলাম এই মেলের সাথে যাতে আমার অনন্যাকে তুমি চিনতে পারো সহজেই । তার রূপের কথাতো তোমাকে বলিনি এখনো। একলহমায় দেখো মনে হবে অপরূপা, অসমান্যা, অতুলনীয়া ! সে চলনে বিপাশা বসু, বলনে বরখা দত্‌, ভূষণে সেনকো গোল্ড, বসনে মোনাপালি । চোখদুটোয় ল্যাকমে-কোহলের চিরায়ত ইশারা, তিলফুলের মত নাসারন্ধ্রে সানিয়ার ছোঁয়া, কর্ণপটহের উপর থেকে নীচ অবধি পাঁচটি ছিদ্রে পঞ্চরত্ন খচিত, ওষ্ঠাধারে ম্যাটফিনিশ!কেশরাজি ? কালো নয় বারগ্যান্ডি বর্ণের... এই ঠিক তোমার গায়ে পড়ন্ত সূর্যের আভা লাগলে যেমনটি হয় তেমনি।

ময়শ্চারাইসড নিটোল বাহুপেশী আর মণিবন্ধে ট্যাটু আঁকা তার, তুমি দেখলেই চিনতে পারবে। সুন্দর করে ম্যানিকিওর্ড হাতের অনামিকায় নক্ষত্রের মত জ্বলজ্বলে হীরকের দ্যুতি আর সাথে এক্সপ্রেস মিউজিক, সুন্দর পেডিকিয়োর্ড পদযুগলের পাঁচজোড়া নখ, দুষ্প্রাপ্য নখরঞ্জনীর বিচিত্রতায় তোমার দিকে প্রকট ভাবে তাকিয়ে আছে । দেখা মাত্রই তুমি বলবে "দেহি পদপল্লবমুদারম্‌" । ভাইটাল স্টাটিস্টিকস্‌ ৩৬-২৪-৩৬ ! মিস কোলকাতা হতে পারতো !

মেঘ , তুমি দেখ, আমার বিদ্যুতলতার মত অনন্যা যেন আমাকে শুধু ভুলে না যায়। আমি কেবলই তার চকিত হরিণীর মত নয়নের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছি। তোমার ধারাবর্ষণে তাকে সিক্ত করে তুমি ফিরে এস আমার কাছে ।

ভলো থেকো মেঘ। আবার দেখা হবে আমাদের !

ইতি

আমার বাউল মন

 ( অঞ্জলি, আটলান্টা পূজারী  )

যদিদং হৃদয়ং

টেমস নদীর বাতাস আজ বড়ই সুখকর  । নদীতীরের শহর লন্ডনে  আজ রাজবাড়ির "শাহী-বিবাহ" অনুষ্ঠিত হ‌ইতেছে ।  রাণীমা এলিজাবেথের বড়নাতির বিবাহ । মাতৃহারা নাতি রাজকুমার উইলিয়ামের সহিত তার ইউনিভারসিটির আটপৌরে  সহপাঠিনী কেট মিডলটনের শুভ পরিণয়ে বাকিংহাম রাজপ্রাসাদের আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হ‌ইতেছে সানাইয়ের অণুরণন । সর্বত্র উড়িতেছে ইউনিয়ান জ্যাকের নীলে লালে শুভেচ্ছা বার্তা । দশ বছরের ঘনীভূত প্রেম আজ পূর্ণতা পাইতে চলিয়াছে । চারিদিকে সাজোসাজো রব । পৃথিবীর  বিভিন্নপ্রান্ত হ‌ইতে নিমন্ত্রিত রাজদূতেরা আসিয়াছেন  । উপস্থিত পাঁচশত সংবাদগ্রাহকেরা । যাঁরা রাজকীয়তাকে অতি রাজকীয় করিবার জন্য আসিয়াছেন । রাজবাড়ির পারিবারিক সমারোহে মোট দুই বিলিয়ন দর্শক উপস্থিত হ‌ইয়াছেন । নবজীবনে প্রবেশের ঠিক পূর্ব মূহুর্ত্তে রাজকণ্যা সকলকে হাত নাড়িয়া অভিবাদন জানাইয়াছেন গতকাল যখন সে আইবুড়ো ভাত  খাইতে ছিল সেই ফাঁকে  পাত্র উইলিয়াম তার বন্ধুদের সহিত দক্ষিণ লন্ডনের ব্যাটার্সি পার্ক-প্রাঙ্গণে ফুটবল খেলিয়াছে ।

 বিমাতা ক্যামেলিয়া তা জানিয়া প্রমাদ গনিলেন " বিবাহের প্রাক্কালে কি প্রয়োজন খেলিবার্? "

উপর হ‌ইতে গর্ভধারিনী  স্বর্গতঃ ডায়না  হুঙ্কার  ছাড়িয়া কহিলেন " উহুঁ উ উ!  না বিয়াইয়া কানাইয়ের মা আইলেন !"  আশীর্বাদ করিলেন " আহা ! উহারে একটু খেলিতে দাও! বিবাহের পর যে কিরূপ রাজকীয় মুষিক-দৌড় শুরু হ‌ইবে !  না জানি আমার ভাবী পুত্রবধূ উইলিয়ামের নাসিকায় দড়ি লাগাইয়া কতকিছু করাইবে!"   

"জানা আছে ! পনের বত্সরের  পুত্রটিকে তো ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলে , এতদিন তো এই আমিই ছিলাম তাহার সাথে; সেন্ট এন্ড্রুজ ইউনিভার্সিটি যাইবার সময় তাহার সেলফোন, রুমাল, টাই , ওযালেট আগাইয়া দিলাম । তাহার শুভ পরিণয়ের সংবাদ পাইবামাত্র চার্চে গিয়া বাতি দিলাম । এত বিশাল ঝক্কি সব একাহাতে সামলাইলাম আর উনি এখন উপর হ‌ইতে ফাঁকা মাঠে গোল দিতেছেন " উইলিয়াম-বিমাতা কহিলেন 

ডায়না বলিলেন " এ আর এমন কি ! "" রাজমাতা যদি সমর্থ হ‌ইতেন একা হাতে এই যজ্ঞ্যি সামালাইবার ক্ষমতা রাখিতেন" ক্যামিলিয়া বলিলেন " হ্যাঁ,  তাঁর তো বাতজবেদনা আর ক্ষণেক্ষণে স্মৃতিভ্রম বর্তমানে,  আর আজকাল রাজবাড়ির দাসদাসীরাও পূর্বের মত নাই । অতএব ফ্যাশন ডিজাইনার হ‌ইতে ভূষণ-পালিশ, সসেজের মশলার অনুপান হ‌ইতে কেকের ব্যাটার সবকিছুই আমাকে দেখিতে হ‌ইতেছে ।  তোমার কনিষ্ঠ পুত্র হ্যারি তো বধূমাতা কেটের ভগিনী পিপার পিছনে ছোঁক ছোঁক করিতেছে । কোনো কাজেই সে লাগিল না । আর তোমার আমার সাধারণ পতিদেব চার্লস মহাশয় তো বার্ধক্যের কারণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ! তিনি শুধু  একটি কাজ‌ই করিতে পারেন । পানশালায় অতিথিদের ঠিকমত পানসামগ্রীর  দ্বারা আপ্যায়ন হ‌ইতেছে কিনা আর এক আধ সুরাপাত্র চুক চুক করিয়া চুমুক দিয়া আমাকে আসিয়া ঘ্ন্টায় ঘন্টায় চুম্বন করিয়া চলিয়া যাইতেছেন । "

ডায়না বলিলেন " এ আর নতুন কথা কি ? আমি থাকিলে এতটা না বাড়িলেও তাঁর ছোটপুত্রের মত তোমার পিছনে ছোঁক ছোঁক করিতেন ইহা তো সর্বজনবিদিত ।আমি কি সাধে পলায়ন করিয়াছিলাম ! ডোডির সাথে না পালাইলে আমার জীবন দুর্বিসহ হ‌ইয়া উঠিত এতদিনে " যাক আজ আমার গর্ভের প্রথম সন্তানের বিবাহ ;  এসব অলুক্ষুণে কথা বলিব না "

এতক্ষণে রাজবাটির দাসদাসীগণ বাকিংহাম প্যালেস হ‌ইতে গায়ে হলুদের তত্ত্ব ল‌ইয়া ওয়েষ্টমিনস্টার এবে অভিমুখে যাত্রা করিয়াছে । বধূমাতার গোলাপী গাউনের সহিত জরির ফিতা বাঁধিয়া, শ্যানেল এইট শিক্ত করিয়া ; রৌপ্য রেকাবে হীরক খচিত ব্রোচ, বিবিধ মণিমুক্তার অঙ্গুরীয় , রতনচূড়, মানতাশা, ইত্যাদি অলঙ্কার ল‌ইয়াছে । কেহ বহন করিতেছে তাহার  কেশ সামগ্রী । কেহ তাহার প্রিয় খাদ্য । বাকিংহাম প্রাসাদের প্রহরীগণ উচ্ছ্বসিত । নতুন লাল পোশাক পাইয়াছে সাথে নতুন কালো লোমের টুপিও ।  রাণীর সভাকবি ক্যারল এন ড্যাফি "রিং" নামক    বিবাহের কবিতা লিখেয়াছেন । দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীটের ল্যারি নামক বিড়াল ক্যাবিনেটের টেবিলে বসিয়া বিবাহ দেখিতেছে ।  সেও রাজবাড়ি হ‌ইতে গলায় বাঁধিবার  ইউনিয়ান জ্যাক ভূষিত ডিজাইনার বো উপহার স্বরূপ পাইয়াছে । বিবাহ সহ দীর্ঘায়িত অবকাশের সপ্তাহ শেষে লন্ডনের নরনারীগণের ফূর্ত্তি লক্ষ্য করা যায় পথিপার্শ্বের পানশালাগুলিতে । ফোয়ারা ছুটিতেছে সিঙ্গলমল্ট হুইশকির ; স্রোতের মত শ্যাম্পেন বহিতেছে । বিয়ারের ঝর্ণায়  সিক্ত হ‌ইতেছে হোটেলগুলির কার্পেট ।  বিয়েবাড়ির ভোজনশালায় নানা রকমের কেকবেকিং হ‌ইতেছে । রাজকীয় "হগ-রোস্টের" ম্যারিনেশন পর্ব চলিতেছে । একদিকে রাজকীয় বার্বিকিউয়ের ব্যবস্থা হ‌ইয়াছে ।  

জনা পঞ্চাশ রাষ্ট্রপ্রধান এবং দুইহাজার নিমন্ত্রিত অতিথির পদার্পণ হ‌ইয়াছে ।  মহিলা অতিথিদের  টুপির বৈচিত্র্যে বিবাহালয় বৈচিত্রময় হ‌ইল । কাহারো মস্তকে একগুচ্ছ গোলাপের চূড়া । কাহারো পাখির বাসার মত লিলিফুলের বেড়া, কাহারো আবার জরির প্রজাপতি । কেউ আবার রংবেরংয়ের পালক সাজাইয়াছেন মস্তকে । এদিকে লন্ডনের বাসন্তী মেঘলা আকাশ; ড্যাফোডিল ও ফুটিয়াছে । দু এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়িয়াছে উহার পাপড়িতে । আম জনতা পথ-উতসবে সামিল হ‌ইয়াছে । কেহ শিবিরে আশ্রয় ল‌ইয়াছে ,   নবদম্পতির মঙ্গল কামনা করিতেছে ।  অবশেষে রোলসরয়েসে চাপিয়া রাজপুত্র লাল পোশাকে  অবতরণ করিল । সাথে বরকর্তা  কনিষ্ঠভ্রাতা হ্যারি । রাণীমা আসিলেন  ডিউক অফ এডিনবরা , ফিলিপের সাথে  । ভ্রূযুগল ঈষত্‌ কুঞ্চিত । তাঁর পুত্র চার্লস সস্ত্রীক উপস্থিত হ‌ইলেন । কিন্তু বিবাহের বধূর দেখা নাই । ভোর ছয় ঘটিকায় শুরু হ‌ইয়াছে তাহার কেশ পরিচর্যা । পাঁচজন  বিশেষ কেশ বিশারদ আসিয়াছেন ।

রাণী এলিজাবেথ বলিয়া উঠিলেন " ঐ কেশ‌ই তাহার কাল হ‌ইল;   আমার বা উহার শাশুড়ি ডায়নার এরূপ তো দেখি নাই । আমাদের সময় এরূপ হ‌ইত না । ঐ জন্যই বলিয়াছিলাম  উইলিয়ামকে " যেমন-তেমন ঘর হ‌ইতে রাজবাটীতে মেয়ে ঢুকিলে সমস্যা হয় ! অমন প্রেম ঘনিষ্ঠতায় পূর্ণতা না পাইলেই নয়? তা পৌত্র আমার শুনিল না "

চার্লস বলিল " আহ্‌, থাম না মা! যা হ‌ইয়াছে ভালোই তো " রাণী ক্রুদ্ধ হ‌ইয়া বলিলেন " মনে আছে ? আজি হতে তিরিশ বত্সর পূর্বে তোমারেও বলিয়াছি এতসব,  তুমি শুনিলে না , দেখিলে তাহার পরিণতি"   চার্লস হালকা হেসে বলিল  " থাক না মা আজ ওসব কথা " 

এরূপ বচসা হ‌ইতে হ‌ইতে যীশুর মন্দিরে পিতার হাত ধরিয়া প্রবেশ করিলেন রূপবতী কেট-কুমারী । সর্বশুভ্রা । মস্তকে হীরের টায়রা  পরিয়া এলোচুলে  । কানে হীরের দুল, গলায় হীরের ফুলফুল হার ।শুভ্র ফুল্ল কুসুমিত অর্কিড  হস্তে  ;  মুখ শুভ্র লেসের কারুকার্য করা উড়নিতে আচ্ছাদিত । ছিদ্র দিয়া সব দেখিতে পাইতেছেন কিন্তু তাহাকে কেহ স্পষ্ট দেখিতেছে না ।  সাদা ঘাগরার পিছনে যত্সমান্য রেশমী রেল । দেখিয়াই রাণি জ্বলিয়া উঠিলেন । 

রুমালে চশমা মুছিয়া ভালো করিয়া দেখিলেন আর ফিলিপকে বলিলেন " আমি এত ঘটা করিয়া দ্বিপ্রাহরিক আহারের বিশেষ ব্যবস্থা করিলাম ।  আর আমার নাত-বৌ এর দাম দিল না ! বেনা ঘাসের অরণ্যে মুক্তা ছড়াইলাম ! হায় যীশু, তুমি কোথায়?"

 ফিলিপ বলিলেন " আহা, অত অধৈর্য্য হ‌ইলে চলিবে রাণী? অধুনাকালের পাত্রী, দিন বদলাইয়াছে । উহারা এখন বৈদ্যুতিন যুগ দেখিয়াছে ।  ফেসবুক করিতেছে । কত কত ডিজাইনারের পোশাক দেখিয়া শুনিয়া বানাইয়াছে ।  নতুন প্রজন্মের নরনারী এরা । তোমার সহিত তুলনা করিলে সংঘাত  হ‌ইবে। চক্ষু মুদিয়া যীশুর  প্রার্থণা কর । রাণি ভুলিবার নয় । বলিলেন " এমন জানিলে! অত মূল্যবান খাঁটি সোনার  হীরের অঙ্গুরীয় উহাকে না দিলেই হ‌ইত ! বানাইয়া দিলাম আমি "  

বিবাহ শুরু হ‌ইল । চার্চের আকাশ বাতাস ঘন্টাধ্বনিতে অণুরণিত হ‌ইল মেপলগাছের পাতাও শুনছে সেই শব্দ । বিউগ্‌ল বাজিতে শুরু হ‌ইল ।  সুরের মুর্ছনায় চার্চ মুখর । ক্যান্টারবেরী চার্চের ডিনের মধ্যস্থতায়  কেটের পিতা সম্প্রদান করিলেন । দুই হস্ত এক হ‌ইল । উইলিয়াম কেটের পাণিগ্রহণ করিলেন । কেটের চোয়াল দৃঢ় হ‌ইল । শপথ নিলেন বর-কনে । সম্মিলিত  প্রার্থনা সঙ্গীত হ‌ইল । ফিলিপ পৌত্রবধূর গর্বে গর্বিত পিতামহ ।

রাণিকে বলিলেন " দেখিলে রাণি? তুমি নাত-বৌয়ের নিন্দা করিতেছিলে , তোমার পুত্রবধূ  স্বর্গীয় ডায়ন র জন্য যে শপথ বাক্য " তোমার সকল আদেশ মানিয়া চলিব " পরিবর্তন করিতে হ‌ইয়াছিল , আমাদের নাত-বৌ  কিন্তু লক্ষীমেয়ের মত অবলীলাক্রমে তাহা উচ্চারণ করিয়া ফেলিল । দেখ এ আমাদের দেখিবে । সেবা করিবে । বড় বাধ্য মেয়ে । আমি উহার পিতামাতাকে জানাই"

রাণী বলিলেন " সাধে কি বলে  পুরুষের বুদ্ধি ! কদাপি মেয়ের প্রশংসা করিবে না, নতুন কুটুম মাথায় চড়িয়া বসিবে"  রাজবাড়ি প্রবেশ করুক তাহার পর যা বন্ধন দিবার আমি দিব । ভবিষ্যতের রাণী হ‌ইবার যোগ্যতা অর্জন করিতে হ‌ইবে না ? আমার যা শরীরের অবস্থা ! আমার উত্তরসুরীকে আমি স্বহস্তে লালন করিব "

চার্লস বলিলেন " মা, দেখ ডায়নাকে কেমন ধরিয়াছিলাম ! কেমন দীর্ঘকায় হ‌ইয়াছে আমার উইলিয়াম , বেশ মানাইয়াছে তাকে দীর্ঘাঙ্গী কেটের পার্শ্বে"

এলিজাবেথ বলিলেন "  বাহ্‌, তুই না হয় নাতিদীর্ঘকায় ,  ভুলিয়া গেলি তুই কাহার পুত্র? তোর পিতার  উচ্চতার  জিনটি পাইয়াছে আমার নাতি "

কলহের অবসান হ‌ইল । রাজরক্ষী আসিয়া রাণিকে গাড়িতে উঠিতে বলিলেন ।  দুধে আলতা পায়ে নতুন বধূ  লাল কার্পেটের উপর দিয়া চলিয়া চার্চের বাহিরে আসিল এবং ১৯০২ সালের প্রাচীন ঘোড়ার গাড়ি করিয়া বাকিংহাম রাজপ্রাসাদ অভিমুখে যাত্রা করিলেন । 

রাজবাড়ির বারান্দায় , পোর্টিকোয়, অলিন্দে  চিলেকোঠার ছাদে এয়োস্ত্রীরা গল্পে, আলাপে আলোচনায় কত রঙ্গতামাশা করিতেছে ।

একজন বলিল " মডেলিং করা মেয়ে , দেখ আবার এ কেমন তর হয় ! "

 কেউ বলিল " " উইলিয়ামের কপালটা তার বাবার মত না হ‌ইলেই হয় , বিয়ের তারিখ দুজনের্‌ই ঊনতিরিশ "

একজন স্মিত হাসিয়া বলিল " ইহারা নতুন প্রজন্মের বরকনে । দশ বছর ধরিয়া বাজাইয়া ল‌ইয়াছে "

অন্য একজন খলখল করিয়া বলিয়া উঠিল " থামো থামো , মাঝে তো একবার ছাড়াছাড়িও তো হ‌ইয়া গেছিল" 

আরেকজন তো বলিয়া বসিল " কেনিয়ার গহন অরণ্যে তো সব হ‌ইয়া গেছে আজকের অনুষ্ঠান তো  প্রহসন মাত্র ।

এক রাজদাসী আসিয়া সংবাদ দিল " আসুন আপনারা বরকনে আসিয়া গেল্, উলু দিন, শঙ্খ বাজান" 

শ্যাম্পেন্-বৃষ্টি-ফোয়ারায়, হৃদয় বেলুন আকাশে উড্ডীয়মান । লন্ডনের  বসন্তে ড্য্যাফোডিল ফুটুক না ফুটুক শুভ পরিণয় সমাপ্ত হ‌ইল নিরাপদে । রাজ বারান্দা তখন চুম্বনময় !

( গুরুচন্ডালী )