Sunday, June 28, 2015

বাঁশে তেলে

যাদব চকোত্তির পাটীগণিত ব‌ইয়ের বাঁদরের সেই বিখ্যাত অঙ্ক মনে পড়ে ? বাঁশের গায়ে তেল মাখানো, বাঁদর কিছুটা ওঠে তো কিছুটা নামে.. এই আমার মত অনামা লেখকের মত । একটু উঠলেই মনে হয় অনেকটা পথ গেলাম । পরক্ষণেই সম্পাদকের অপছন্দের মেল আসে উড়ে। আবার নামো ঐ বাঁদরের মত। চিরটাকাল ঐ অঙ্কটাকে ভয় পেয়ে গেলাম আর সেই অঙ্ক‌ই আমায় তাড়িয়ে নিয়ে চলল সারাটা জীবন ধরে। আমার মা বলতেন সংসারে যে সহে, সে রহে, সারদামায়ের কথা। সেই আপ্তবাক্য মাথায় করেই চলি। তবে বাঁদর হতে চাইনে। স্বামী বলেন বাঁদর আর খারাপ কি হল? রামচন্দ্রের সেতু বাঁধার সময় কত কত বাঁদর তাঁকে সাহায্য করে ফেমাস হয়ে গেল। তুমিও তো বাঁদর হয়ে সেলেব হতে পারো। শ্বশুরবাড়িতেও সেই এক টানা আর পোড়েন। আমার দিন যাপনের চিত্রটা সেই বাঁদরের মত‌ই থেকে গেল শয়নে, স্বপনে, জাগরণে। একহাতে ঝিনুকবাটি অন্যহাতে দাঁতকপাটি। সকলের মন জুগিয়ে চলো। তরতর করে পার হবে বৈতরণীর ঢেউ। একটু তেল কম পড়েছে তো ব্যাস্! পা স্লিপ করে নামো সেই সাপলুডোর নিরানব্ব‌ইয়ের ঘর থেকে সজোরে শূন্যোয়। আপাতভাবে মনে হচ্ছে তো ? যে তেল কম পড়লে স্লিপ করবে কেন? তেল বেশী দিলেই তো স্লিপ করে পড়ার কথা। কিন্তু না, সংসারে তা হয়না বন্ধু। তেল কম পড়লেই পা স্লিপ করে। তাই গরগরে কালিয়া কিম্বা তেলে চুপচুপে বেগুনীর মত করে তেল ঢেলে যেতেই হয় এখানে, অহোরাত্র। আরে মশাই সংসারটাও তো রাজনীতির জায়গা না কি! স্বামী এদ্দিন বাদে বললেন ফিসফিস করে। বাড়ির ভেতরে চাপা চাপা রাজনীতি। বাম আছে, ডান আছে। কৌরব আছে, পান্ডব‌ও আছে। লুডোর চালটা তোমার হাতে। সেখানে মন্থরা আছে, কৈকেয়ী আছে। শকুনিও আছে রিভেঞ্জ নেওয়ার জন্যে। তোমাকে এত্তগুলো প্যারামিটার কব্জা করে একহাতে বাঁশ ধরতে হবে শক্ত করে আর অন্য হাতে নিতে হবে তেলের বাটি। সব তেল চলবেনা। একটু দামী তেল নিতে হবে মানে অলিভ অয়েল হলেই বেষ্ট। কোলাপ্সিবল গেটের না হয় কঠিন হৃদয়, পোড়া মোবিলেও মন ভেজে তার কিন্তু মানুষ যে বাঁদরের উত্তরপুরুষ তার তো চাই খাঁটি তেল। অবশেষে একস্ট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল নিয়ে এলাম। হাজার টাকা কিলো বলে কতা! সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবেনা। সকলের হৃদয়ের খেয়ালও হল, আবার আমার বাঁশটা একটু বেশিই তৈলাক্ত হল। অতএব এগোও চটপট। কৌরবপক্ষ আপাতত মুখে কুলুপ। হঠাত একদিন দুপুরে তাদের ইচ্ছে হল অপন্না সেনের "গয়নার বাস্ক" খুলে দেখার । বুক মাই শো! বাড়ির নাকের ডগায় সিনেমা! কত যত্ন করে, নো রিফিউসাল ট্যাক্সি করে সিনেমায় নিয়ে গেনু, হাফটাইমে চিপ্স-পপকর্ণ খাওয়ানু, বেরিয়ে এসে এগ-চিকেন রোল অর্ডার দিনু! পরদিন লেডিজ পার্কে হাঁটতে গিয়ে ফিরে এসে শাউড়িটা কি নেমোখারামি কল্লে! বলে কিনা তার বান্ধবীরা মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখতে গেচে, পিত্জা খেয়েচে আরো কত কি! মানে আমার সব তেল জ্বলে শেষ এক নিমেষে! বুঝলাম আরো তেল চাই নয়ত আমার বাঁশ আর আমাকে নিয়ে যাবেনা একটুও। আর আমার ঐ জা'টা সে কেবলি কুমন্ত্রণা দেয় কানে কানে! বলে যেমন আপনি আদিখ্যেতা করেন আপনার ছোটোবৌমাকে নিয়ে! সেবার সাধে দিয়ে দিলেন সলিড সোনার ধেড়ি ঝুম্কো, আর আমার বেলায় ঝুটো পাথরের দুল ! গয়নার বাস্ক দেখে এসে ওবধি বুড়িটা খুব হুঁশিয়ার হয়েচে, বলে আর আঁচলের চাবির গোচা ভুলেও তোমাদের কাচে নয়! নাহ্! বিশ্বাস নেই! আমার জা যখন যেমন তখন তেমন, যেখানে যেমন, সেখানে তেমন। সাপের গালেও হামি খায় , ব্যাঙের জিভেও জিভ ঠেকায়। চোর কে বলে চুরি করতে আর গেরস্তকে বলে সাবধান হতে। প্রথম প্রথম বুঝতামনা। আমাকে সিনেমা দেখাচ্ছে, কবিরাজী কাটলেট খাওয়াচ্ছে আবার আমার বাপেরবাড়ি যাত্রায় আল্হাদে আটখানি হয়ে আমার শাশুড়ি মা'কে বিলাতি আইসক্রিম খাওয়াচ্ছে। বাসকিন রবিনস খেয়ে তেনার কি আনন্দ ! এসেই দেখি পার্টিতে দিদিভাইয়ের গলায় তেনার জাল-ফাঁশ হারখানা। মনে মনে বলে উঠি "এ মনিহার আমার গলে নাহি সাজে দিদিভাই" তুমি জালি করো আর আমায় ফাঁসিয়ে দিতে ওস্তাদ এক মহিলা অতএব "বধু ধরো ধরো মালা পরো গলে!" কাজের লোক না এলে রান্নাবাড়ি, ঝাড়াপোঁচা, বাসন-কাপড় সব আমার ভাগে। কেন না বড় বৌমা ইস্কুলের দিদিমণি। মাস গেলে চাঁদির জুতোর তৈলাক্ত শুকতলা দিয়ে তেনার জন্যে পয়লা বোশেখে স্লিভলেস হাউসকোট, বলরামের সুগারফ্রি মিষ্টি, মনজিনিসের মনের মত জিনিষ, তেনাদের শোবার ঘরের লেসের পর্দার কাপড়, পুজোর সময় জরিপাড় সাউথ কটন আসে। না হয় সেগুলো আমার অলিভ অয়েলের চেয়েও ঢের দামী তাই বলে ওনাকে একটু রান্নাঘরে যেতে বললেই বলেন সংসার আমার নয়, তোমাদের। বাড়ি আমার। বোঝো ঠ্যালা! আরে ভাই এতো সেই মুকুল মার্কা কতা হল! আমি সরকারের কেউ ন‌ই। আমি দলের । অবশেষে বাঁশ আবার ছুলতে বসি। আরো মসৃণ হবে পথ। মাখাই হরেক কিসিমের ঘি, মাখন, রিফাইন্ড অয়েল। তবুও সুযোগ পেলেই বুড়িটা বাঁশ দেয় আমাকে। যাকে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা। ওনার বাঁশটা ইসপেশাল বাঁশ, মানে ইংরেজীতে যাকে বলে "বাম্বু" । অদৃশ্য বাম্বু। ওনার মাথার বাঁদিকের কোনো এক চোরাকুঠুরিতে রাখা থাকে। আর পারলে উনি না ছুলেই প্রয়োগ করেন সেটি, কখনো আমার ওপর কখনো বুড়ো শ্বশুরটার ওপর, অথবা আমার একমাত্র গৃহপালিত স্বামীটির ওপর। একদিন হয়েচে কি আমার উনি ওনার উনিকে চুপিচুপি বলচেন, বাবা, চলো আমরা একদিন সকলে মিলে হোটেলে খাই। উনি শুনতে পেয়েই বললেন, "ঐ দ্যাকো, আবারো তেল দিচ্ছে আমাদের গো! ঐ যে পরের মাসে তোমার কিষাণ বিকাশটা ম্যাচিওর করচে, ঠিক খেয়াল আছে ওদের। উড়োজাহাজের মত বুদ্ধিটা বোধহয় বৌয়ের। মাগের ভেড়ো তো একটা। উঠচে আর বসচে ঐ মেয়েটার কতায়!” আমি পর্দার আড়াল থেকে একগাল হেসে বলি "উড়োজাহাজ না রকেট" । ঠিক অশ্বত্থামা হত ইতি গজর মত মৃদু স্বরে। কারণ তিনি শুনতে পেলেই ব্যস্! গুষ্টির তুষ্টি করে আমার ফষ্টিনষ্টি মাঠে মেরে দেবেন। বোঝো কান্ডটা! আমি হতভাগী জানিওনা ওনাদের কিষাণ বিকাশ আচে না ম্যাচিওর করচে! স্বামীকে বল্লুম, এমন করে আর থাকা যাচ্ছেনা, চলো আমরা অন্য কোথাও চলে যাই। শাউড়ি শুনলে আবারো বাণ মারবে আমাকে। এবার আমি রেডি হলুম মনে মনে। উনি বাণ মারলেই আমি যা মুখে আসবে তাই বলব। আবার ভাবছি বাঁশ দিতে গিয়ে বনফুলের "পোড়ার মুখী"র মত উল্টে আমার চোয়াল আটকে যাবেনা তো! বিয়ের পরদিন ঘোমটাটা এট্টু সরিয়েচি, ব্যাস্! উনি ক্ষেপে ব্যোম্‌ ! আর এখন নিজে স্লিভলেস নাইটি পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে ওপারের ফ্ল্যাটের মাসীমার সঙ্গে সিরিয়ালের কতো গপ্পো কচ্চেন? সেই সাথে আমাকে বাঁশ দেবার কৌশলটাও ঝালিয়ে নিচ্চেন। ঘরে এসেই ঐ মাসীমার ছেলে-বৌ তাদের কত সুখে রেখেচে তার ফিরিস্তি। মানে তেলও চাই আবার বাঁশ দেওয়াও চাই। ভুলি নাই ভুলি নাই সেদিনের কথা। একদিন দিদিভাই মানে আমার জা স্কুল থেকে আসতেই তাকে বললাম ব্যাপারটা। সে বলল, "ভালো তো আরো তেল মাখা, আরো ক্রেডিট নিতে যা, তোর বরাতে এমনি জুটবে। তুই কি ভাবছিস, এ সংসার রাজনীতির খেল? যে তেল মাখালো সে টেন্ডার পেল, আর কংক্রিটের জঙ্গল বানিয়ে পয়সা কামিয়ে নিল? মোটেও নয়, এখানে আছে সূক্ষাতিসূক্ষ সম্পর্কের টানাপোড়েন, বুঝলি। তুই যখন শাউড়ি হবি তখন তোর বৌও এক হাত মে তেল কা শিশি আর অন্যহাত মে বাঁশ নিয়ে খেলবে তোর সাথে। মেনোপজ বুঝলি না ? মেনোপজ হল যত্ত নষ্টের কারণ। উনি এখন টোট্যালি পজড আর তুই-আমি এপ্রোচিং । বুড়োটাও খিটখিটে, বুড়িটাও তাই। তেল দিলেও কোনো লাভ নেই। পারলে জাপানী তেল নিয়ে আয়। বুড়োটাকে গিফ্ট কর। বুড়োটা সোজা থাকলে বুড়িও আরাম পাবে। আর বুড়ি আরাম পেলে আর আমাদের পেছনে লাগবেনা, বুঝলি? “ কিন্তু সেদিন যে বুড়ি বলছিল, একটা বয়েসের পর স্বামী-স্ত্রী ভাই-বোনের মত বাস করবে, ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলে গেছেন। আরে ঐ জন্যেই তো বলচি তোকে, "সব কিছুর মূলে ঐ জাপানী তেলের খেল! মনে নেই সেই গ্রাইপ ওয়াটারের এডটা? বংশ পরম্পরায় চলতেই থাকে সদ্যোজাতের পেটব্যাথা আর তখন একমাত্র সুরাহা গ্রাইপ ওয়াটারে। আর তাহলেই দেখবি অচিরেই বুড়িটার সেই অদৃশ্য বাঁশটার ডগাটা ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে, মসৃণ থেকে মসৃণতর থেকে মসৃণতমের দিকে এগুচ্ছে। " সবশেষে বলি রান্নাঘরের রসনার তৃপ্তিও কিন্তু তেলে। বাংলার অন্যতম তেলেভাজা শিল্প থেকে শুরু করে তেল কৈ অথবা পাবদামাছের তেলঝাল এ সবের মূলে তেল। আর ঐ যে সব শিল্পকর্ম, অনুষ্ঠানের মঞ্চবাঁধা থেকে শুরু করে উঁচুবাড়ির ভারা বাঁধা কিম্বা কয়লার আঁচে পোড়ানো ম্যারিনেটেড মুরগীর টুকরোকে বাঁশের মধ্যে পুরে বাম্বুচিকেন??? এসবের মূলে কিন্তু বাঁশ। অতএব বাঁশ ও তেল এ দুয়ের সহাবস্থানে জীবন চলছে চলুক। যদি জীবন চায় আরো বেশিকিছু বাড়িয়ে কমিয়ে নিন না বাঁশের সাইজ ও তেলের পরিমাণ!!! যাক্‌ আর তেলা মাথায় তেল দিলাম না। বড্ড তেলতেলে হয়ে যাবে । তেলেভাজা শিল্প হয়ে আসুক সিঙ্গুরের শিল্পমাঠে। আর বাঁশ শিল্প হোক বাঙ্গালীর নন্দনে-বন্দনে। বাঁশের ফুলদানী, ল্যাম্পশেড নন্দিত হোক মেলাপ্রাঙ্গণে। বাঁশ আর তেলের জয় হোক! জয় বংশদন্ডের জয়! জয় তৈলশিল্পের জয়!

উত্তরবঙ্গ সংবাদ রবিবার  

No comments:

Post a Comment