Monday, June 8, 2015

সিনান যাত্রা

 সিনান যাত্রা 

জগাদার ঘরের পাশেই বিমলিপিসির ঘর। একটু আড়ালে, একটু আবডালে।  খিড়কির দোর খুলে অবাধ যাতায়াত, অনায়াস গল্পগাছা, ফষ্টিনষ্টি  । সারাদিন জগাদার শৃঙ্গার, ভৃঙ্গার, ছাপ্পান্ন ভোগের  হুজ্জুতিতে বিমলিপিসির সাথে দেখা করার ফুরসতটুকুনি হয়না। 

বিমলি পিসি বলে বলে থকে গেল। চান করাতে পারবেনা তাকে। সেই সাথে তার ভাইবোনেদেরো। চান করতে বললে জগাদা রেগে আগুণ, তেলে বেগুণ।  এদিকে রোজ রাতেরবেলায় খিড়কির দোর খুলে বিমলিপিসির একটিবার না দেখা হলেও নয়। জগাদার ঘুম আসেনা। বিমলিপিসিও ছটফট করতে থাকেন। উড়িষ্যার ঐ প্রচন্ড দাবদাহে দিনের পর দিন, ঘন্টার পর ঘন্টা   জগাদা স্নান না করে গু-শুকনি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন লাঠিসোঁটা নিয়ে। শীতকালে না হয় রোজ স্নান না করলেও চলে। তারপর চৈত্র গিয়ে বোশেখ এলে জোর করে তাকে চন্দন যাত্রায় পাঠানো হয়। আবার একমাসের মধ্যেই প্রচন্ড গরমে হাঁসফাঁস। বিমলিপিসির মন মানেনা।

 রোজ রাতে বলেন
"শোনো নাগর, স্নান না করে আমার কাছে এলে গায়ে হাত দিতে দেবোনা, বলে দিলাম, অতএব পোস্কার ঝোষ্কার হয়ে এসো বাপু! একেই সারাদিনে শরীরে পচা জবাফুলের গন্ধে আমার ত্রাহি ত্রাহি ডাক। তারপর সিঁদুরের ঠেলায়, তেলে, জলে আমার শরীরটা শেষ। মেয়েরা আজকাল নিজেদের মাথায় সিঁদুর দেবেনা আর আমাকে পারলে সিঁদুরে চুবিয়ে রাখবে। সেই সাথে বেলপাতা, পদ্ম...ভক্তদের আদিখ্যেতায় আমি মরি আর কি!”

 সারাদিনের এই অত্যাচারের পর তিনি আসবেন চান না করে। এসেইমা বিমলা ওরফে আমাদের বিমলিপিসিকে  জড়িয়ে ধরবেন। সেই পেঁড়া-গুঁজিয়ার মুখেই চকাস চকাস করে পটাপট চুমু খাবেন।  কি দুর্গন্ধ মুখে! সেই কোন সকালে একবার নিমের দাঁতন বুলিয়ে নিয়েছেন দাঁতে। না টুথপেষ্ট না মাউথওয়াশ। আর সারাদিন ধরে চলছে তার ছাপ্পান্ন রকমের মিষ্টি গেলা।

"আমার  হাতদুটোতো নেই, জানো বিমলা। আমি তো ঠুঁটো হয়েই রয়ে গেলাম। একটু তাই আমার মুখ সর্বস্ব চেহারাটা দিয়েই না হয় তোমাকে সারাদিনের শেষে পেতে চাই। তাতে এত কথা? ঠিক আছে যাও, কাল থেকে আর রাতে আসব না তোমার সাথে দেখা করতে।" জগাদা বলল 
বিমলা বলে, "আহা, রাগ কচ্চো কেন নাগর? আমি কি আসতে বারণ করলাম? আমি তো তোমাকে একটু  স্নান করে আসতে বলছি শুধু! আমার যে এই গরমে বড্ড ঘেন্না করে। তুমি তো জানো সারাদিন আমিও অপেক্ষা করে থাকি এই রাতটুকুর জন্যে, উড়িষ্যায় একেই গরম আর এখানেই তুমি সহজসঙ্গী, আমার প্রাণের ভৈরব "  
"ঠিক আছে, কথা দিলাম বিমলা, ভৈরবী আমার। এবার থেকে স্নান না করে তোমার কাছে আর আসব না "

বিমলা একগাল হেসে নাকে গামছা   বেঁধে বললেন, "একটু তফাতে যাও। আগে স্নান করো, তারপর কাছে আসবে।"
জগাদা ঘষ্টে ঘষ্টে সরে গিয়ে দাঁড়ালেন, একটু মনক্ষুণ্ণ হলেনো বটে! 

"মনে আছে মিন্‌সে? জৈষ্ঠ্যমাসের পূর্ণিমা আসছে, তোমার হ্যাপি বার্থডে"  বিমলিপিসি বললেন কিঞ্চিত ধমকের সুরে । বছরে ঐ একটাদিন  তুমি সম্বচ্ছরের স্নান করবে ;  চন্দন, অগুরু আর ১০৮ কলসের জল ঢালা হবে, তোমার মাথায়। সেই সাথে তোমার দামড়া দাদাটা আর ছোট বোনটার মাথাতেও।  ঐ জম্মের বুড়ি কম্ম! একদিনে বহু স্নান! বুঝি না কি আর? সব লোক দেখানো। সব প্রাপ্তিযোগের আশায়। তার চেয়ে বাবা আমি রোজ দু-মগ গায়ে ঢালি। আমার দরকার নেই অমন স্নানে।"
জগাদা আর থাকতে না পেরে বললেন, "আহা আমাদের তিন ভাইবোনের কি আর তোমার মত সোনার অঙ্গ? আমরা তো দারুব্রহ্ম, জানোতো তুমি! এসব পুরোণো কাসুন্দি ঘেঁটে কি লাভ তোমার?"
"দারুব্রহ্ম না হাতি! গর্ভগৃহে  কাঠের পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোজ রাতে একটু আধটু দারুও চলে তোমাদের। সে কি আর জানিনা ভাবো?"
"নাগো বিমলা, না। আমরা খাইনা। বলুদাদা খায় শুধু। আমারা ঘুমিয়ে পড়ি গল্প করতে করতে। তারপর দাদা আর বোন ঘুমোলেই আমি টুক করে চুপিচুপি তোমার কাছে চলে যাই" 
  "তোমাদের এই  বার্ষিক স্নানকৃত্যর অদিখ্যেতা দেখলে আমার যে কি হাসি পায় বাপু !“
একপাল লোকের সামনে দিয়ে স্নান করতে যাবে চারজনে মিলে। তোমরা তিন ভাইবোন আর সুদর্শন। খোলা স্নানবেদীতে দাঁড়াবে চারজনে। আর অতজোড়া চর্মচক্ষু গিলবে তোমাদের্! তোমাদের আর কি! ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়!  তোমার শুভ জম্মোদিন বলে কতা! রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন কি চালাকই না ছিলেন! সারাবছরের ঐ একটি দিনে মন্দিরের তহবিলে বেশ ভালোরকম আমদানী হয়। নাম দিয়ে বসলেন, চন্দন যাত্রা, স্নান যাত্রা, রথযাত্রা, দোলযাত্রা .. " বিমলা বলল।

তারপর একশো আট কলসীর পুণ্যজল, শুভজল, ভালো জল, পবিত্র জল,  বিশুদ্ধ জল সব একে একে তোমাদের মাথা থেকে সর্বাঙ্গে ঢালা হয়। সুকুমার রায়ের অবাক জলপানের মত যেন অবাক জলস্নান! তারপর সকলে পরবে হাতির মুখোশ। একে বলে গজবেশ। গণেশকে একটু মান্যি করলে আরকি! বিমলিপিসির  কোলের ঐ ছেলেটার পুজো না হলে কোনো শুভ কাজ হয়না যে ।
তারপর বাবুদের জ্বর আসবে। সত্যি সত্যি আসবে কি না জানিনা, তবে জ্বরের ভান করে, জরজর থরথর অঙ্গ নিয়ে  চারমূর্তি মচ্ছিভঙ্গ হয়ে পড়ে থাকবে ঘরের কোণে।
"পূর্ণিমার তিথিতে অমন ভয়ানক স্নান করলে জ্বর আসবেনা? একে প্রবল তিথি তায় আবার সম্বচ্ছরি স্নান! ব্যথায় বেদনায় কাবু তো হবই"...  জগাদার গলায় অভিমানী সুর। রোজ রোজ স্নান করতে দেবেনা, কাঠের শরীর ক্ষয়ে যাবে বলে। আর যেদিন স্নান করাবে সেদিন এমন স্নান করাবে যে তেড়ে জ্বর এসে যাবে আমাদের্! মা বলতেন" তাত সয় তো বাত সয়না!"  আমি বাপু তাই এই এত জলটলে স্নান করতে নারাজ। 

 তোমাদের আবার প্যারাসিটামল চলেনা!   তারপর রাজবৈদ্য আসবে। এই সময় কেউ তাদের মুখ দেখবেনা। তারপর রাজবৈদ্যের প্রেসক্রিপশান অনুযায়ী এক আয়ুর্বেদিক পাঁচন প্রস্তুত হবে।  এক পক্ষকাল সেই পাঁচন খেয়ে তেনারা জ্বর থেকে মুক্তি পাবেন!   "অনসর" বলে এই সময়টাকে।  বিমলিপিসি বললেন । 

স্নানযাত্রা কাটতে না কাটতেই রথযাত্রা বাম্পার মোচ্ছব! শুধু ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকলেই হবে?  পেজ থ্রি কাঁপাও জগাদা তিন ভাই-বোনে মিলে। বোল্ড এন্ড বিউটিফুল সুভদ্দোরার বেদিং বিউটি পাবলিক গিলবে খুব। লুফে নেবে প্রিন্ট মিডিয়া। তোমার হান্ডি উপচে পড়বে..  প্রচুর এড পাবে এই স্নানযাত্রা মহাযজ্ঞে।    যাও জগাদা, বিমলিপিসিকে নিয়ে একটা সেলফি তুলে ফেসবুকে পোষ্টাও। উড়িষ্যা তথা সারাদেশের ব্র্যান্ড এমবাস্যাডার তুমি। নিজের ব্যান্ড নিজেই বাজাওগে। স্নানযাত্রার আগের রাতেই পাবলিককে স্টেটাস আপডেট করে জানিয়ে দাও "আগামীকাল আমাদের মহাস্নান, অল আর ওয়েলকাম! একবার ছেড়ে দিলে সোনার গৌর আর তো পাবেনা! অতএব শুভস্য শীঘ্রম্‌!"

(কলকাতা -২৪x৭)  

No comments:

Post a Comment