Sunday, June 7, 2015

কৃপা করো FMCG রে


ভোর হল, টিভি খোল, ছেলে বুড়ো জাগো রে
ঐ ডাকে এড-মামা, কেনাকাটি শুরু রে!
সকাল হলেই দাঁতমাজা দিয়ে শুরু হোক ভোর তোমার । ভোরের আলো দুচোখে মাখতে মাখতে চেয়ে দেখ কত্ত সব আয়োজন তোমার বত্রিশ পাটির সুরক্ষার ও সুগন্ধের জন্য । পর্দার একপাশে বাবু একপাশে বাবা । পারলে যতবার খাও ততবার দাঁত পালিশ করো । কেউ বলছে এই মাজন তো কেউ বলছে ওই । কোনটায় দাঁত হবে লোহার মত শক্ত, কোনটায় পাথর । সেই ঠাকুমার ঝুলির গল্পের মত লোহার কড়াই কড়মড় করে চিবিয়ে খেতে পারবে তুমি ! এক্সট্রা শাইনের জন্য আর একটু পয়সা বেশি দিলে পাবে নোনতা মাজন । দাঁত-পালিশের পর গা-পালিশ । আছে স্নানের সময় গায়ে মাখার জন্য সৌন্দর্য-বার সাবান, পরিচ্ছন্ন-কেক সাবান, দীপ্তিময়-লাবণ্যের প্রতিশ্রুতি বদ্ধ আরো সাবান ; সোনার চেয়েও সোনা হবে ত্বক ! সোনার চেয়েও দামী হবে তুমি ! গোল্ডলাইট কালেকশানের মত হালকা ফুরফুরে হবে তুমি । তারপর ফেসওয়াশ, বডিওয়াশ, হ্যান্ডওয়াশ । সাবান ! তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে ! এক সাবানের কত রূপ ! এক কার্বনের কত বহুরূপতার মত । কখনো হীরে, কখনো চারকোল, কখনো আবার ভুসোকালি । পারলে গেয়ে ওঠ "এক‌ই অঙ্গে এত রূপ দেখিনি তো আগে" !
এবার কেশ পরিচর্যার ঘটা । হেয়ার ফল এক্সপার্ট থেকে হেয়ার কালার এক্সপার্ট । হেয়ার শাইন এক্সপার্ট থেকে ড্যানড্রাফ এক্সপার্ট সকলেই আছেন এক আকাশের নীচে । শুধু তুমি আছ ওপারে । মাথার যে চুল এতদিন তোমার বশে ছিল, সে এখন চুল এক্সপার্টের কারসাজিতে তোমার স্ক্যাল্পে প্রাণ খুলে তাথৈ নৃত্য করছে । চুল যেন চুল নয়, শীতের হাওয়ায় দমকে দমকে দোলালাগা ধানগাছ!
স্নানসেরে এবার ত্বক-পালিশ !হরেক কিসিমের ক্রিম থরেথরে সাজানো শুধু তোমার জন্য ! শুধু তোমার কেনার অপেক্ষায়! ত্বকে কালো ছোপ তোলার ক্রিম, কালো স্পট তোলার স্পেশাল ক্রিম , চোখের কালি পোঁছার ক্রিম, ফর্সা হবার ক্রিম এমন কি চাকরী পাবার ক্রিম । ফল খেওনা, বড্ড দাম যে ! তার চেয়ে ফল চটকে ক্রিমে দেওয়া হচ্ছে যা রোজ মাখলে প্রিয়তম একদম ফিদা । ফলের নির্যাস, নামীদামী বাদামের তেল, ডিমের কুসুম, ডাবের জল, গোলাপের পাপড়ি, কমলালেবুর খোসা কি নেই এতে ? পাকাপেঁপে থেকে শসা , পিচ থেকে জলপাই সব মাগ্যির ফল আছে এই সব ক্রিমে । সকাল সন্ধ্যে ঠাকুরের সামনে এক কৌটো ক্রিম রেখে দাও আর মাঝে মাঝে একখাবলা তার থেকে নিয়ে মুখে মেখে নাও । আহার ওষুধ দুইই হবে । একে নৈবেদ্য তাতে তেলতেলে ক্রিম ! ভগবানও খুশ আর তুম ভি ! নিজেকে একবার দেখে গেয়ে উঠবে " একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ এসো হে"
মেয়েরা ক্রিম মেখে আসছে যুগ যুগ ধরে আর ছেলেরা কি চেয়ে চেয়ে দেখবে ? মুখ তুলে চেয়েছেন ভগবান । ফেয়ারনেস ক্রিমের যাদুতে আজকাল নাকি ছেলেদের চাকরীও মিলছে । কে বলেছে রিসেশন ?কে বলেছে ভাল কলেজে না পড়লে ভাল প্লেসমেন্ট হয় না ? ফর্সা হলে চাকরী অবধারিত।
এড আসে এড যায়, ক্রেতা টিভি পর্দায়
ঝক্কাস বকবাস, ক্রেতাকুল বিন্দাস !
এবার গিয়ে বস ব্রেকফাস্ট টেবিলে । পাশে খবরের কাগজ খোলা আর সামনে খোলা টিভি । সুতরাং আবার কর্ণ এবং চিত্তশুদ্ধির ধারা অব্যাহত ।
তর্কের তুফান তোল গিন্নীর সাথে । মনের খচখচানি; মাখন না মার্জারিন? কোনটায় বিদ্ধ হবে পাঁউরুটির শাণিত তরবারি?
আবার যুক্তির ফুলকি এসে পড়ল টেবিল-চাদরে "কোন‌ তেলে ভাজা হবে প্রাণের অমলেট খানি ?" সূর্যমুখী, সয়াবিন না কি রাইসব্র্যান অয়েল "? কেউ বলে পুফা, কেউ বলে মুফা, কেউ বলে দুইই ! পুফা ও মুফা নিক্তির ওজনে থাকলে তোমার হৃদয়ের "লাব-ডাব"এ হবে ফাইন টিউনিং ! হৃদয়ের কলিজা ওরফে অর্ধাঙ্গিনী কাছে এলেই শুনতে পাবে তোমার দিল কি ধড়কন ! তুমি মিষ্টি হেসে গাইবে "আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে" কিম্বা গিন্নী গাইবেন "আমার এই দেহখানি তুলে ধর" শক্তিমানের মত !
দুঃখের যজ্ঞ অনল জ্বলনে ব্রেড-অমলেটের আহুতি দিয়ে এবার অফিস । গিন্নি ততক্ষণে কাজের লোকের হাতেহাতে এগিয়ে দিচ্ছেন ঘরমোছার হলদে বোতল, ঘর পরিষ্কারের সবুজ বোতল, ঘরকে জীবাণু মুক্ত করার সাদা বোতল । কাপড়কাচার জন্য লেবুর শক্তিওলা ডিটারজেন্ট, গোলাপের গন্ধ , জুঁইফুলের গন্ধ ওলা হাতের বন্ধু সাবান গুঁড়ো । রঙীন জামাকাপড়ের জন্য এক , সাদার জন্য আর এক । শুধু কৃপা করো এফএমসিজি রে ! বিদ্যুতের ঝলকানি চলে যায় সাদা শার্টের বুকের ওপর দিয়ে; সেই হঠাত আলোর ঝলকানি লেগে দর্শক কাম ক্রেতার ঝলমল করে চিত্ত ;
টু'মিনিটের ম্যাজিক-মশালায় সারাদেশের মানুষ আজ নুডলসের বশে ! লাঞ্চবক্সে , ডিনারে , জ্বর হলে , অতিথি আপ্যায়নে , ক্ষুধাতাড়নায়, গৃহিনীর সুবিধার্থে নুডলস । নুডলসের খালি প্যাকেট আপনি পেয়ে যাবেন বদ্রীনাথ আশ্রমের সংলগ্ন পাহাড়ে কিম্বা দশম ফলসের ঝোরার জলেও । এ যেন বন থেকে বেরোলো এক্কেবারে সোনার টোপর মাথায় দিয়ে ! ভিনি, ভিডি, ভিসি ! রাতারাতি নুডলস দুনিয়ায় সেলিব্রিটি । ছেলেবুড়ো সকলের স্টেপল ফুড । চিন্তা করা যায় ? মিড ডে মিলে নুডলস চালু হল বলে !
অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হয় কি রাঁধি? চোখের সামনে ম্যাজিক মাংসের মশালা । শুধু মেশান, মাখুন আর জমিয়ে দিন । সারাদিন পর বাড়ি ফিরে নিজের ছেলেকে দেখে মনে হল কিস্স্যু খায় না, তখনই স্বাস্থ্যসম্মত হেল্থ ড্রিংক ফুরফুর করে ভেসে উঠল পর্দায় । একটা জাম্বো ডিবের মধ্যে সব ক'টি প্রয়োজনীয় উপাদান ভর্তি করে সীল করে দেওয়া আছে সোনামনির জন্যে । এ স্বাস্থ্যপানীয় বেঁটে বাচ্ছাকে লম্বা করে, বোকাকে বুদ্ধি দান করে আর দুর্বলকে সবল করে । পরক্ষণেই আর একজন বলছে যারা অঙ্ক পারেনা, যারা পড়া ভুলে যায় তারা খাবে আগের পানীয়টির এম + + অর্থাত ম্যাথস + এবং মেমারী + । বুঝে নিতে হবে তোমাকে, দাম দিতে হবে তোমাকে । আছে গর্ভবতী মায়ের জন্য, পরিশ্রমী গৃহকর্ত্তার জন্য, হাড় ও বাতের ব্যাথায় কাতর গৃহবধূটির জন্য একদম কাস্টমাইজড হেলথ ড্রিংক । মা বাড়ি আসামাত্রই ছেলের অভিযোগ, সাইকেল থেকে তার পা কেন মাটি অবধি পৌঁছায় না ? গাছের আম কেন ধরা দেয় না তাকে ? মা যারপরনাই চিন্তায় । পরক্ষণেই প্রবলেম সলভড । তাকে এনে দিলেন সেই ম্যাজিক প্ল্যান্ড-হেল্থ ডিঙ্ক ।
এদিকে মামি বলে নুডলস, টামি বলে স্যুপ! টানাপোড়েনে জর্জরিত বালক পড়ার ঘর থেকে উঁকি মারে টিভির পর্দায় ; হয়তবা শচীনের হাতে সই করা ব্যাটের লোভে কিনতে চায় কিছু কিম্বা ওয়ার্ল্ডকাপের টিকিট পাবার আশায় মরীচিকার পেছনে ছুটে যায় পাশের ঘরে আর বলে "বাবা, এটা দেবে কিনে"
মা ততক্ষণে বালকের সামনে সুদৃশ্য বোল নিয়ে হাজির তিব্বতী থুক্‌পা নিয়ে !
তারপরই বীজানু শূন্য জল পাবার উপায় । দেখতেই হবে মন দিয়ে সেই কবে স্বাস্থ্য ব‌ইতে পড়েছিলে না ? "জলই জীবন"
কাদাগোলা একগ্লাস জলের মধ্যে দিয়ে সোঁ সোঁ করে অতিবেগুনী রশ্মে গিয়ে সব পোকা মেরে দিল নিমেষের মধ্যে আর তুমি পেলে এক গ্লাস স্ফটিক স্বচ্ছ জল । সাথে সাথেই অন্য একজন বলল " মিথ্যে কথা " বিশুদ্ধ জল আমি দেব । আমি ভাই অত শত বিজ্ঞান বুঝিনা । কার কথা শুনব ? আবার কন্ট্রোভার্সি । আর সাথে সাথে অবাক জলপান !
তার সাথে আছে শহরের আনাচকানাচের বিউটিশিয়ানদের ব্যয়বহুল বাক্যি । তাদের প্রতেকের স্ব স্ব ব্র্যান্ড । বাক্সের এপারের নীরব দর্শক হয়ে আমি ভাবি "সেই ভালো সেই ভালো, আমারে না হয় না জানো, সেই ভালো সেই ভালো " কত অভিজ্ঞ এই রূপবিশারদেরা ! আমারে তুমি অশেষ করেছ । আর নয় । আমার নাই বা হ'ল পারে যাওয়া । মাঝে নদী বহে রে । ওপারে তুমি রাধে এপারে আমি । ক্ষতি কি ! আমি তো আর রিয়েলিটি শোতে যাব না । ডিম খেও না, কোলেস্টেরল বাড়বে । তার চেয়ে মাথায় মেখে ফেল কুসুম আর গালে ডিমের সাদা ! যেমন হবে কেশ তেমন হবে ত্বক ! বললেন বিউটিদি বা রূপোলীপর্দার রূপসীদি । পরক্ষণেই দেশের ডিম-কোঅর্ডিনেশন কমিটি এসে বলল রোজ একটি করে ডিম খেতে । তাহলে শচীনের মত হাট্টে-গাট্টে হবে । তোমার হাতের কবজী হবে ভূপতি-পেজের মত । এদিকে বাক্সের এপারে আমার অবস্থা আমার শেষ পারাণের কড়ি দিয়ে কি কিনি ? আগে ডিম না আগে ক্রিম ?
যে যত ঢাক পেটায় তার তত ব্যবসা । আরে বাবা আমাদের দেশটা আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেবে কি করে নয়ত ! তিনহাজার কোটি সন্তানের ভারত আমার ভারতবর্ষ । বিজ্ঞাপন! তুমি না করিলে কে আর করিবে এদেশের উদ্ধার ?
চোখ মেলে দেখ । এত জিনিষপত্র বিক্রি হচ্ছে ঐ তিনহাজার কোটি দর্শকের তিনশো টিভি চ্যানেলে । তুমি না কিনিলে কি করিয়া দেশ হ‌ইবে শাইনিং !
এই তো চাই ! উত্তিষ্ঠিত ক্রেতাগণ! জাগ্রত ক্রেতাগণ !
বোকাবাক্সে চোখ মেলে থাক ।
ভারতবর্ষের আজ সুদিন এসেছে ।
যাই দেখি, কে আবার বাজায় বাঁশি আমার ঐ টিভির স্ক্রীনে!!! 

উত্তরবঙ্গ সংবাদ রবিবার   

No comments:

Post a Comment