Thursday, October 15, 2015

বেশ করেছি ! মাই চয়েস!!

মনে পড়ে কবীরসুমনের সেই বিখ্যাত গান "সব আমাদেরি জন্যে, আমাদেরি জন্যে..."  । ভিনরাজ্যে গিয়ে থেকে তো দেখেছি মশাই। এই চৈত্তসেলের জন্যে ফাগুণ পড়তেই মন কেমন উশখুশ করে!  এমন সেলের পসরা কোথাও পাবে না কো তুমি। সেবার সেই বাম জমানায় সুভাষবাবুর তাড়ায় অপারেশন সানশাইনের কবলে পড়ে রাতারাতি গড়িয়াহাট খালি । ফাগুণে সে বিরহব্যথা যে কি জিনিষ তা আমি বুঝি।  । কোথায় আমার পায়জামার দড়ি! কোথায় গেল জামাকাপড় শুকোনোর ক্লিপ্! কোথায় পাই আমার সাধের জাঙ্ক জুয়েলারি, টিপ-ক্লিপ আর কুশন কভার? আর পয়লাবৈশাখে বাড়ির দোরে নতুন ডোরম্যাট? কিনব‌ই তো ! মাই চয়েস! 

কি ভালো ছিল আমার সেই হকার ভাইটা! মাঝবয়সী আমাকে এখনো বৌদি বলে ডাকে।  একবাক্যে জিনিষের দাম আর্ধেক করে হাসিমুখে বলে, নিয়ে যান, পরে দাম দেবেন। এত আন্তরিকতা কোথায় পাব বলতে পারো? তাই ওকেই আমার এত পছন্দ। মাই চয়েস! 

মায়ের মলমল ছাপাশাড়ি আর শ্বশুরমশাইয়ের হাফপাঞ্জাবি না হয় কিনলাম দোকান থেকে। তাই বলে নিজের হাউসকোট কিম্বা কাজের মেয়ের ম্যাক্সি? কক্ষণো নয়। বেঁচে থাক ফুটপাথ! আর ওখানে কেনার চার্মটাই আলাদা!  কত্ত চয়েস! কত্ত আন্তরিকতা হকার ভাইদের!চাকরী জোটেনি তাই টিউশানির পয়সায় আমার গুড টাইমপাস। আমি বড়বড় দোকানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত উইন্ডোয় চোখ রাখি আর উইন্ডো শপিং করি। কিন্তু কিনি ফুটপাথ থেকে। আমার হকার ভাইটিও বিএ পাস করে হকার হয়েচে। গর্বের সাথে বলে সে।    হকারকেই আমার দরকার এই চৈত্তসেলে, কুর্তির ঝুলে। এইজন্যেই তো পড়ে র‌ইলাম কলকাতায়।  তাও মাই চয়েস! 

এই শহরটার জন্মলগ্নে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৃহস্পতি তুঙ্গে জানেন তো? তাই কর্তা নামেন বালিগঞ্জ স্টেশনে, গিন্নী নামেন গড়িয়াহাটে।  তারপর ছুঁচোর ডন বৈঠক  দেওয়া পেটে ঐ ফুটপাথের এগরোল কিম্বা চাউমিন, মোমো কিম্বা ফিশফ্রাই সাবাড় করে চৈত্তসেলে পথ পেরোন তাঁরা। আহা কি আনন্দ তখন সেই পথচলায়! যিনি মেট্রো করে নামেন রাসবিহারী তাঁর জন্য আছে রাসবিহারীর বিস্তীর্ণ দুপারের প্লাসটিক বালতি, মেলামিনের বাসন থেকে কাটগ্লাসের সুরাপাত্র, বাথরুম সেট, পুরণো ম্যাগাজিন থেকে পাইরেটেড সিডি, রেডিমেড ব্লাউজ, সায়া থেকে শার্ট-প্যান্টের পিসে ঢালাও সেল। কি চাই! রাসবিহারীর মোড় থেকে রসা রোডের দিকে কালীঘাট  পেরিয়ে হাজরা আর এপাশে দেশপ্রিয় পার্ক পর্যন্ত সেলে ডুবে আছে মহানগরী। ভেতরের জামা, বাইরের জামা, পর্দার কাপড়  সবেতেই সেল। গয়নার মজুরি ফ্রি। আবার সোনা কিনলে সম ওজনের রূপো ফ্রি! ভাবা যায় এই পয়লা বৈশাখের কি মহিমা? 
 
ওদিকে বঙ্গললনার এখন টেলিভিশনে মাস্টারশেফ দেখে দেখে বড় সাধ জাগে একবার কন্টিনেন্টাল কিম্বা ইটালিয়ান বানানোর। বিশ্বায়নের  ঢেউ লাগা সাফসুতরা রাস্তায় এখন বাটন মাশরুম থেকে বেবিকর্ণ, সুইট কর্ণ থেকে ব্রকোলি, তেরঙ্গা সিমলা মির্চ কি না পাওয়া যায়! 
 কেউ নামেন শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশনে। তাঁর গার্ল ফ্রেন্ড হয়ত কলেজ ফেরত আসেন সেথায়। তারপর শুরু হয় সেল পরিক্রমা। আদিগন্ত হাতীবাগান জুড়ে সেল, সেল, সেল। আর সে যুগে যারা স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অমোঘ বাণীকে পাথেয় করে ব্যবসায় নেমেছিলেন  তাদের দোকানে হাহুতাশ!  নিউমার্কেটে তারা নাকি অবস্থান করছেন হকারদের বিরুদ্ধে। আরে বাবা ! বোঝেনা সে বোঝেনা।  তার বাপ-ঠাকুরদার এদ্দিনের ব্যাবসাপাতি নাকি হকারদের কল্যাণে লাটে ওঠার উপক্রম! ক্রেতা বলেন  যেখানে সস্তা পাব, সেখানে যাব। বিক্রেতা বলেন এসি দেব, ভ্যাট নেব, রসিদ দেব। আর নেতা বলেন হকার আমার মাটি। হকার আমার ভোট। হকার আমার ভাগ্যনিয়ন্তা। "সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই".... সেই কোন্‌ যুগে চন্ডীদাস বলে গেছেন।  সুভাষবাবুর অপারেশন সানশাইনের পর হকার পুনর্বাসন হয়েছিল। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি জানেন? কেউ যায়নি নতুন বাড়িতে। ক্রেতা খোঁজে সস্তার জিনিষ। বিক্রেতা চায় বিকোতে। কারণ এ শহরে শিল্প আসেনি তেমন করে। তাই ইকনমিক গ্রোথ হয়নি বুঝি। তাই ক্রয় ক্ষমতা বাড়লনা বোধহয়। তাই ফুটপাথেই উঁকিঝুঁকি আর হাতড়ে মরা সাধের জিনিষগুলোর জন্যে। 
ওদিকে উঁচু উঁচু শপিং মলের বাতানুকুল বায়ুমন্ডলে ম্যানেকুইন ডুকরে কাঁদে। পথিক আসে দর্শক হয়ে। চোখ বুলায়, হাত বুলায়। পিছন পানে চায়। সেখানেও সেই এক অছিলা। মাই চয়েস!  

এতো গেল পথেঘাটে প্রাক্‌বৈশাখী প্রস্তুতি।  চাদ্দিকের  চৈত্তসেলের হাতছনি। এবার আসি ডিজিটাল সেল প্রসঙ্গে। সেখানেও নানান অফার। সবকিছুই বর্ষবিদায়ের আনন্দে।  গড়িয়াহাটার মোড়ে, হাতিবাগানের ধারে কিম্বা নিউমার্কেটের আশেপাশে নয় কিন্তু।  শ্যামবাজারে বা কসবাতেও নয়। এ হল আমাদের ডিজিটাল চৈত্তসেল। সেল, সেল, সেল, ফেসবুক পাড়ার সেল । দুটাকা বাঁচানোর সেল, পয়লা বৈশাখী সেল।  এই এক হয়েচে বাপু। প্রতিবছরে চৈত্র গিয়ে বৈশাখ আসবে আর তার জন্যে বছরের বস্তাপচা জিনিষ পত্তরের স্টক ক্লিয়ারেন্স সেল হবে। তুমি বাপু বিক্কিরি কত্তে পারছোনা তাই দাম বাড়িয়ে সেল ঘোষণা করেছ আর আম-আদমী ভাবছে কি সস্তা! কোথায় লেডিজ প্রিমিয়াম টপস পাওয়া যাচ্ছে দুটো, একটার দামে।  "বাই ওয়ান, গেট ওয়ান" যাকে বলে।  কোথাও আবার বিক্রি বাড়াতে হবে বলে বাই টু গেট টু।   ঐ দোকানে বেষ্ট ডিল অফ ইয়ারিংস। আসলি মুক্তো, আসলি জারকোন  মাত্র ঐ দামে? নো ওয়ে! এমন স্বপ্ন কখনো দেখিনি আমি!  কুর্তা, কুর্তি অনবরত দৃষ্টি কেড়ে নেয় । কারে ছেড়ে কারে ধরি!  আনারকলি, নূরজাহান সকলেই আছেন এক ছাদের নীচে। শুধু অপেক্ষা একটা ক্লিকের। 
পোলকা ডটের কুশন কভার, হালকা-পুলকা কস্টিউম জ্যুয়েলারি, প্যাস্টাল শেডের সুদৃশ্য বেডস্প্রেড এমন কি গৃহসজ্জার দৃষ্টিনন্দন আর্টিফ্যাক্টসও, বুদ্ধ-গান্ধী-বিবেকানন্দ সকলেই উপস্থিত!  সখের পোশাকী চটি জোড়া থেকে হাঁটার জন্য  গুরুগম্ভীর স্নিকার্স, রান্নাঘরের ঘটিবাটি থেকে পড়বার ঘরের তাক, ময়লা ফেলবার ভ্যাট। সবেতেই সেল দিচ্ছে তারা সারা বছর ধরে। শুধু তোমার ক্লিকের অপেক্ষা। আর তারপর এড টু কার্ট, ব্যস! বেশ করব কিনব। মাই চয়েস!  

চৈত্রসেল পেরোতে পেরোতেই বৈশাখী হেঁশেলের তোড়জোড়। মোচ্ছব সেখানেও। হোটেলে হোটেলে রসিক বাঙালীর খাদ্য বিলাস। শুরুতেই কাঁচা আমের জুসের সাথে ভদকার অভিনব ককটেল।অথবা তরমুজের লাল রসে পুদিনার সবুজ। ওপর থেকে আধ পেগ হোয়াইট রাম।   যাকে বলে ফিউশান শরবত। তারপরেই লুচি, বেগুনভাজা, শাক-শুক্তো-ছ্যাঁচড়া-মুড়িঘন্ট। পরের দফায় ঘি ভাত, তপসে ফ্রাই। নির্গুণ, নির্গন্ধা বেগুণ দিয়ে বেগুণ বাসন্তী থেকে শুরু করে সারাবছর অচল পটলের দোলমা। ঘিভাতের কত রকম নাম হয় আজকাল! সে কখনো দারুচিনিদেশে, কখনো মখমলি জুঁইফুলের বাগিচায়। গাছপাঁঠার মুইঠ্যা তো পনীর পসন্দ।  যশুরে তেল কৈ কিম্বা বরিশালী ইলিশ। কোথাও মৈথিলী ভেটকি, কোথাও আবার মাটন মনোহরা। শুধু চমকে যাওয়া নামের অভিনবত্বে।  মধুরেণ সমাপয়েত ম্যাজিক মিহিদানা অথবা রসোগোল্লার পুডিং দিয়ে। আরো ভালো যদি থাকে  জলভরা জলপরী কিম্বা  দৈ কলসের ঠান্ডা ছোঁয়া।  আর তারপরেও চালিয়ে দেওয়া যায় কেশরীয়া মালপোয়া কিম্বা যুবতী এক জিলিপিকে। ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব স্বয়ং বলেছিলেন ভরাপেটেও জিলিপি জিভ থেকে টুকুস করে, অতি অনায়াসে গলার মধ্যে দিয়ে সোজা পেটে চালান করা যায় । যেমন খুব ভীড়ে লাটসাহেবের গাড়ির চাকা ফাঁকফোকর দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে যায় সাবলীল গতিতে। 
সব শেষে বলি এবারের বৈশাখী শ্লোগান হল পুরভোটের। থুড়ি মেয়েদের জন্যে। স্থলে-জলে-অন্তরীক্ষে আমি আছি আমার পছন্দ নিয়ে। মাই চয়েস! বেশ করেছি, ফুটপাথ থেকে জিনিস কিনেছি, মাই চয়েস! বেশ করেছি হকারকে প্রশ্রয় দিয়েছি। মাই চয়েস! ডিজিটাল শপিংও করেছি অনেক। কারণ মাই চয়েস। পার্সে ক্রেডিট আর ডেবিট কার্ড। আমাকে আর পায় কে? বৈশাখে খাদ্যবিলাসেও সামিল হয়েছি কারণ মাই চয়েস! হোমমেকারের হেঁশেলের চাক্কা বন্ধ পয়লা বৈশাখে। কারণ মাই চয়েস! রাঁধছিনা, রাঁধবনা। আজ স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ সব তোমাকে দিলাম পয়লা বৈশাখ। কারণ মাই চয়েস!   

( আনন্দবাজার ইন্টারনেট, পয়লা বৈশাখ

No comments:

Post a Comment