Monday, July 18, 2016

হেডাপিসের বড়বাবু

সোমবার এলেই মুখটা ব্যাজার হয়ে যায় বড়বাবুর । আবার আপিস শুরু । আপিস মানে রোজ সকলকে বেজার মুখে যেখানে যেতে হয় ! যদি সরকারী আপিস হয় আর যদি বাঙালী সেখানকার বড়বাবু হন তাহলে একটু আধটু দেরী করলে বড় একটা ক্ষতি নেই । তিনি বেলা দশটা পার করে এলেই হবে । তাঁর ক্ষেত্রে সময়ের বিশেষ ছাড় । তিনি আপিসের পাপসে দশটা বেজে দশ মিনিটে পা দেবেন তো দশটা বাজতে দশে নয়। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মাথা পুঁছবেন । পকেট থেকে রুমাল বের করে চশমার কাঁচ পুঁছে চিরুনিমাসীকে হাতে ধরে আয়নার সামনে যাবেন । আম-বাঙালীর মত বড়বাবুরও ভিশন খুব একটা প্রবল নয় তাই সকলের মত বড়বাবুর চশমা চোখে । এপাশের চুল ওপাশে রাখবেন খুব ধীরে সুস্থে । তারপর আফ্রিকার মানচিত্রের মত চকচকে টাকটিকে দেখে নেবেন চট করে । এবার মুখটা কুলকুচি বেসিনে । গিন্নীর দেওয়া আদরের পানের কুচোটুচো গুছিয়ে ফেলে দিয়ে টেবিলের দিকে । তখন ঘড়ির কাঁটা পৌনে এগারোটা ছুঁই ছুঁই । টেবিলে বসেই মাথা গরম । বিস্তর ফাইলের স্তূপ । ধূলোটাও ব্যাটারা ঝেড়ে দেয়না আজকাল । এবার মুঠোফোনের টুংটাং । শালী, আধা ঘরওয়ালির দুষ্টুমিষ্টি ফচকেমি.. দু-চার মিনিট । ততক্ষণে আপিসের বাইরে মামণি টি-ষ্টলের মামণি এসে চায়ের গেলাসে ঠকাস করে চা রেখে চলে গিয়েছে টেবিলে । কিছুটা চেঁচানো" বিস্কুট কৈ রে মামণি?" এই কত্তে কত্তে সাড়ে এগারোটা । এবার ফাইলের স্তূপ থেকে সীতা উদ্ধারের মত করে টেনে হিঁচড়ে একখান চোতা কাগজ বের করে তাতে নিজের নামটা স‌ই করা হল । সেই মহাযজ্ঞে আরো একটি ঘন্টা কাবার । এবার মামণির মা এসে বলে " স্যার, আজ কি খাবেন?রুটি-ডিমের কারি, পরোটা-আলুর দম না এগ-চাউচাউ?" মামণির মায়ের ঝটিতি আগমন ও প্রস্থানে কিছুটা শান্তি ও আপিসে আসার তৃপ্তি । বেঁড়ে খাবার বানায় বৌটা । বাড়িতে তো "এটা খেওনা, ওটা খেওনা".. কত্ত শুল্ক চাপানো! আর আপিসে নো কোলেস্টেরলের কচকচানি ! মামণির মায়ের হাতের গুণে সব অসুখ উধাও । শুধু সুখ আর সুখ ! ঠিক একটা বাজতে না বাজতেই মামণির মায়ের হাতে ধোঁয়া ওঠা নিত্য নতুন ডিশ! বাড়িতে তো গিন্নীর সিরিয়ালের দাপটে রান্নার মেয়েছেলেটা সাত সকালে হুড়মুড় করে রুটিটাও ক্যাসারোলে ভরে রেখে চলে যায় । আহা! মামণির মায়ের হাতের ফুলকো ফুলকো রুটিটাও কি দারুণ লাগে তখন খিদের মুখে । এবার মুখটুক পুঁচে টুচে মগজের গোড়ায় আনফিল্টার্ড ধোঁয়া দিতে একটু পাপসের বাইরে পা । একটু আড্ডা, আধটু ধোঁয়া ছাড়া । রাজনীতির কূটকচালি থেকে শেয়ারমার্কেট । চেয়ারের গদিতে ফিরে আসতে আসতে তিনটে । আবার চায়ে চুমুক, সাথে মামণির হাসিমুখ । বুদ্ধি খুলে গেলে একটু কারোর পেছনে কাঠি করা নয়ত টেবিলে মাথা রেখে ছোট্ট ন্যাপ । হার্ট ভালো থাকে এতে । বয়স তো আর কম হলনা বড়বাবুর ! চারটে বাজলেই ব্যাস্! এবারে আর কে পায়! পাপসের বাইরে পা । পাঁচটায় মেট্রোতে পা দিতে পারলে শান্তি । আর ছটায় বাড়ি ফিরেই আবার চা । এবার কালো-চা। এক টুসকি বীটনুন আর দু ফোঁটা লেবুর রস দেওয়া কেফিন। এন্টি অক্সিডেন্ট, ফ্ল্যাবোনয়েড সব আছে এই চায়ের মধ্যে । গিন্নীর বচন, খনার চেয়েও দামী । সারাদিন ধরে কাগজ আর টিভি সার্ফ করে সঞ্চিত জ্ঞানকণা ! হার্ড লাইফ বলে একে! এই কত্তে কত্তে আরো চারটে বছর পার করে দিতে পারলে ব্যাস! রিটায়ারমেন্টের পর বাড়ি বসে বসে পা নাচানো আর মাস গেলে পেনশন । সমস্যা একটাই, কারণে অকারণে গৃহযুদ্ধ । মঙ্গলবারে বড়বাবুর ফাইলের জঙ্গল সাফ করার কথা। কিন্তু সাফ করব বললেই কি আর করা যায়? সেদিন আবার মামণির চায়ের দোকানে আলু পরোটা মেলে। অফিসে গিয়েই মন উশখুশ করে কখন আলুপরোটা নিয়ে হাজির হবে মামণিসোনা। বাড়িতে সুগারের প্রকোপে আলু নৈব নৈব চ! বুধবারে বাবু কোনো ভালো কাজে হাত দেননা। কেউ কিছু স‌ইসাবুদ করাতে এলে বলেন "রেখে যাও ভাই, আজ হবেনা!" আমার জন্মলগ্নেই নবমপতি বুধ অষ্টমে বিরাজ করছে। তাই জ্যোতিষি বলেই দিয়েছিলেন বুধবারে কোনো কাজে হাত না দিতে! বিষ্যুদবার গুরুবার। বাড়ি ফেরার পথে উপোসী গিন্নীর জন্যে দৈ-মিষ্টি নিয়ে ফিরতে হয়। সকালে আপিসে এসেই সেই কথাটা বারেবারে মনের কোণে উঁকি দেয়। গিন্নী একা একা সাবাড় করে সেনমশায়ের লাল দৈ আর দেলখুশ! আর বাবু সুগারের করাল চাউনিতে চেয়ে চেয়ে তা দেখেই যান। সেই মন খারাপের জেরে সকাল থেকে কোনো কাজেই মন লাগেনা যেন। শুক্কুরবার মানেই উইকএন্ডের শুরু। আমেরিকার লোকজন কোথায় তখন ফ্রাইডে পার্টির আলোচনা করে! বাবুর আপিসে সেসবের বালাই নেই! পার্টি হলে একটু জমিয়ে নিষিদ্ধ পানীয়, মুরগী মটন পেটে পড়ার স্কোপ থাকে। সেই নিয়ে ভাবতে ভাবতে টেবিলে বসে বসে লম্বা হাই তোলেন তিনি! কে যে বলে! এই দেশেতেই জন্ম যেন, এই দেশেতেই মরি! কক্ষণো নয়! মরিব মরিব সখী নিশ্চয় মরিব । কিন্তু এদেশে আর জন্মাব না। আর শনিবারের হাফবেলাটা কোনো রকমে পার করেই বাড়ি গিয়ে মটন স্টু দিয়ে ভাত খেয়েই দিবানিদ্রা যান বাবু। অতএব আপিসে গিয়ে নতুন কোনো কাজে হাত লাগানোর কোনো কোশ্চেন নেই। কেউ কোনো মিটিং ডাকলে বাবু বলেন, বারবেলায় মিটিং নাস্তি। এভাবেই কাটে হেড আপিসের বড় বাবুর সাপ্তাহিক আপিস ভ্রমণ । তিস্তার জল বয়েই চলে আপন খেয়ালে। নেপালের মাটি চিড় খায়। সলমনের মামলায় রায় হয়। হৃত্বিকের ডিভোর্স হয়। সানিয়াকে টপকে যায় সাইনা। আইপিএলে কেকেআর ইডেন কাঁপায়। বাবুর পত্নী মদনগোপালের পুজো করে চলেন মমতাভরে। বাবুর টেবিলের ফাইল লালকুঠি থেকে নবান্নের নীলকুঠিতে যায় কয়েক ক্রোশ পথ ঠেলে। বাবুর বদল হয়না। সোম থেকে শনি এক‌ইরকম কাটে। কখনো মেঘ, কখনো বৃষ্টি। কখনো রিসেশন, কখনো ইনফ্লেশন। কখনো পরিবর্তন কখনো প্রত্যাবর্তন । কখনো লাল কখনোবা নীল ফিতের ফাইলে বিশেষ চিঠি আসে বাবুর টেবিলে। বাবু প্রমোশন পান এভাবেই ।
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ৭ ই আগষ্ট ২০১৬

No comments:

Post a Comment