Sunday, June 28, 2015

হায়রে ! হিপোক্রেসী।

ঠাকুর রামকৃষ্ণ নাকি প্রায়শ‌ই বলতেন! দুস্‌ শালা! উনি বললে সাতখুন মাপ আর ছেলের সামনে ভুল করে "শালা" বলে ফেললেই ব্যাস্! সংসার রসাতলে। চায়ের দোকানের ভোরের আড্ডায় প্রবেশ করেই ভুতুবাবুর চোখ কপালে! দোকানের মালিক তখনো চা চাপায়নি। ভুতুবাবু বলে উঠলেন খচ্চরটা আজ দেরী করিয়েই ছাড়বে। দোকানের মালিক পটল বললে, ভুতোদা রাগ করছেন কেন? সক্কালবেলা গালাগালি না দিলেই নয়? ভুতুবাবু বললেন, শালা ! তোমার দোকানে চা খাওয়া বন্ধ করতেই হবে দেখছি। টিঙ্কুর মা আড়ালে কাজের লোককে ঝি-মাগি বলে। টিঙ্কু বোঝেনা তার মানে। একদিন সেই ঝি-মাগিটির সামনেই টিঙ্কু ফোনে বলে বসল, মা এখন ঝি-মাগীর সাথে রান্নাঘরে কাজ করছে। তারপর সেই ঝি-মাগিটি চলে গেলে টিঙ্কুর মা তো তাকে মেরেই ফেলে আর কি! শাশুড়ি বৌমাটিকে বলে মাথায় কাপড় দিতে আবার নিজে নাইটি পরিহিতা হয়ে বেডরুম থেকে সানন্দে লিভিং রুমে অবতীর্ণ হন একপাল জনতার সামনে। ছেলের ওপর বৌয়ের দখলদারির তীব্রতা প্রমাণ করতে মা ছেলেকে আখ্যা দিলেন "মাগের ভেড়ো" । সেই শুনে ছেলেও রেগে উত্তেজিত হয়ে মা'কে জবাব দিল "এ আর নতুন কথা কি! বাপ্‌ কা বেটা, বুঝলেনা? ঠাকুমা বাবাকে বলত "স্ত্রৈণ" মা বলল "চো‌ওপ্" !!! এভাবেই জল গড়িয়ে চলেছে ভারতবর্ষে। যার বাহুমূলে যত জোর, গালাগালি তার! রাজা শশাঙ্কের আমলে মাত্সন্যায় ছিল। এখনো সেই ট্র্যাডিশন চলে আসছে। সবল দুর্বলের ওপর অত্যাচার করবে এটাই তো স্বাভাবিক। সে ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ হোক, শ্বশুরবাড়ি হোক কিম্বা রাজনীতির আঙিনা। আধ্যাত্মিক কুশীলবেরাও কত ভুল করেন ভারতবর্ষের "ধার্মিক" প্রেক্ষাপটে। কিন্তু তেনারা হলেন রাজারাজড়া, দেবতার জাত। অতএব কিং ক্যান ডু নো রং ! ঠিক ঐ গালাগালি দেবার মত। আমরা, ধর্মভীরু ভারতবাসী যুগ যুগ ধরে চোখ বুঁজে ফুল ছুঁড়ে আসছি তাদের পায়ে । আসলে আমরা হনু হিপোক্রিট। হিপোক্রেসি আমাদের মজ্জাগত। দেবদেবী থেকে শুরু করে আমজনতা সকলেই যেন এক রকম। চৈত্রমাস নাকি মধুমাস। কারণ রামায়ণের হিরো রামের জন্মমাস। শুক্লা চৈত্রনবমীতে রামচন্দ্রের জন্মদিন। যে মানুষটা গণতান্ত্রিক স্বার্থে বৌকে ত্যাগ দিয়েছিল ? রাবণের ঘরে সীতার দিনযাপনকে কলঙ্কিত করে সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে বাধ্য করেছিল তার জন্য ঘটা করে জন্মদিন? মানতে বড় কষ্ট হয়। আদর্শবান পুরুষচরিত্র হয়েও সীতার দুঃখ বুঝতে পারেনি সে হেন পুরুষনায়কের জন্য ছেলের মায়েরা রামনবমীর উপবাস করেন। ভাবতে কষ্ট হয়। মনে মনে বলি, রামের চৈত্রমাস, সীতার সর্বনাশ। কৈ সীতার আত্মত্যাগের জন্য কেউ তো সীতার জন্মদিন পালন করেনা? রামকে নিয়ে কত ভজন গান হয়। কিন্তু সীতার জন্য ক'জন ভজন গান? এমনকি "পঞ্চকন্যা"... অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা ও মন্দোদরীর সাথে এক আসনেও সীতা স্মরেণ্যা ও বরেণ্যা নন। রাম নাকি দ্বাপরে কৃষ্ণের অবতার। তাই তার সাতখুন মাপ? এই রাম রাবণকে যুদ্ধে হারিয়ে বধ করবে বলে ধনুকভাঙা পণ করেছিল। মা দুর্গার স্তব করেছিল। আর শরতকালে দুর্গাপুজো করবে বলে দেবতাদের ঘুম পর্যন্ত ভাঙিয়েছিল অকালবোধন করে। রাম ঘরের সম্মান রাখতে পারলনা অথচ নিজের স্বার্থে দুর্গা নামে আরেক শক্তিশালী নারীর পুজো করতেও পিছপা হলনা! হায়রে! হিপোক্রেসি ভারতের ধর্মের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নিজের প্রয়োজনে এক নারীর পায়ে একশো আট পদ্ম দিয়ে পুজো হল অথচ রাবণ বধ করে সীতাকে লাভ করে অন্যের কথায় বৌকে ত্যাগ দিল! সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে বাল্মীকির আশ্রমে পাঠাতে যার একটুও বুক কাঁপলনা ! এ হেন রামের অয়ন অর্থাত গমন পথকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছিল আমাদের মহাকাব্য রামায়ণ। কিন্তু সীতার পাতাল প্রবেশ কিম্বা অগ্নিপরীক্ষা কি তাকে মনে রাখেনা? সীতা মাটির কন্যা আবার মাটিতেই মিশে গেছিলেন। তাই সীতায়ণ বা সীতার গমন পথও তো হতে পারত এই মহাকাব্যের নাম। মাটির কন্যা সীতা লাঙ্গলের ফলা বা "সীত" থেকে উঠে এসেছিলেন। আবার অত্যাচারে, লাঞ্ছনায় অতিষ্ঠ হয়ে বসুন্ধরার কোলেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাই নিজের জীবনচক্র তো নিজেই সমাপ্ত করলেন। রামকে এত প্যাম্পার করে, আদর্শের মুন্ডপাত করে হোক না সীতায়ণ!!! মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণও কিন্তু ব্যতিক্রম নয় । কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পান্ডবদের জেতানোর জন্য তিনি অনেক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। জারসন্ধ হত্যার জন্য ভীমকে ইঙ্গিত করা থেকে জয়দ্রথকে মারার চক্রান্ত করে আচমকা যুদ্ধক্ষেত্রে আঁধার ঘনিয়ে এনেছিলেন। তিথি নক্ষত্র না মেনেও সূর্যগ্রহণ ঘোষিত হয়েছিল। আমাদের কাছে শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু পুরুষোত্তম। টেলিভিশন খুললেই এখন বিদ্যা বালনের সেই মুখঝামটা? কনে বৌটির ছাতনাতলাতে মাথার কাপড় এক মুহূর্তের জন্য সরলেই ব্যস্! অথচ সেই গেঁয়ো কনে বৌ বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির বাইরে খোলামেলা লোকালয়ে যাবে শৌচকর্ম করতে! তার বেলা? হাইট অফ হিপোক্রেসি ! এভাবেই ভারতবর্ষ বেঁচে থেকে গেল রাম-সীতার আদর্শ আঁকড়ে, শ্রীকৃষ্ণের পরকীয়াকে ভীষণ ধর্ম, ধর্ম বলে। ধর্মের অনুশাসন বলছে "ডু হোয়াট আই সে, ডোন্ট ডু হোয়াট আই ডু"। অতএব ভীতু ভারতীয় মেনে নিল মুখ বন্ধ করে। বাড়িতে কন্যাসন্তানের জন্মের খবরটি সুসংবাদ বলে বিবেচিত হয়না আজো। পুত্রসন্তান হবার খবর এলে শাঁখ বাজিয়ে প্রচার করা হয় সেই শুভবার্তাটি। সেই কন্যারত্ন যখন দেবী লক্ষ্মী, সরস্বতী, কালী বা দুর্গা তখন কিন্তু মহাসমারোহে শঙ্খধ্বনিতে তাকে বরণ করা হয়। আজো গ্রামে গঞ্জে পুত্রসন্তানের অন্নপ্রাশনে ঘটা হয় কিন্তু কন্যাসন্তানকে কোনোক্রমে ঠাকুরবাড়ির প্রসাদান্ন মুখে দেওয়া হয় মুখেভাতের নিয়মরক্ষা করে। পুত্রসন্তানের জন্মদিনে পায়েসের বাটি-মাছের মুড়ো ঘটা করে তোলা হয়। আর মেয়েসন্তান বুঝি ইতুপুজোর ব্রতদাসী উমনো-ঝুমনোর মত দুর্ভাগা। গরীব বামুন বাপ তাদের পিঠে খেতে দেয়নি। বামনী যখন পিঠে ভাজছিল গন্ধ পেয়ে মেয়েদুটোর চোঁয়াপোড়া, কাঁচা-খরা পিঠে খাবার নোলায় দেওয়া হয়েছিল বনবাস স্বরূপ চরম ছ্যাঁকা । আবার সেই উমনোঝুমনো যখন ইতুদেবীর পুজো করে রাজরাণী হল তখন তাদের গরীব বাপ যেন তাদের পায়ে ধরে! কারণ তারা তখন বিত্তবান কন্যা, রাজার ঘরণী, বামুন বাপের মুখ উজ্জ্বলকারী কন্যাশ্রী। বাপ পারলে তখন মেয়েদের পুজো করে! আবারো এসে যায় জনস্বার্থে প্রচারিত বিদ্যাবালনের সেই বিজ্ঞাপনটি। প্রিয়ঙ্কা ভারতী নামে গ্রামের মেয়েটি তার স্বামীকে বলে কয়ে শৌচাগার বানায়। প্রিয়ঙ্কা এখন গাঁয়ের হিরোইন । বিয়ের রাতেই বেড়াল মেরেছে সে। শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়েই নতুন বৌ শান্তশিষ্ট স্বামী নামক গৃহপালিত জীবটিকে বশ করেছে দেখে তার শাশুড়িটির কি জ্বলুনি ভাবুনতো! টেলিভিশনে সেই কীর্তি দেখে জনৈক শহুরে শ্বশ্রূমাতা বললেন "ছিঃ, ছিঃ, বশীকরণ জানে মেয়েটা। আর বরটাও henpecked!থাকিস তো গাঁয়ে, বনেবাদাড়ে পটি করগে যা, তাই বলে বিয়ের রাতেই বরকে বশ করা!" আসলে শ্বশ্রুমাতাটি এতসব শোনাচ্ছিলেন তাঁর নবপরিণীতা বৌমাটিকে। পাছে তার ছেলেটি হাতছাড়া হয়ে না যায়। তাই বলে খোলা স্থানে শৌচকর্মের সাথেও নো কম্প্রোমাইজ।

উত্তরবঙ্গ সংবাদ রবিবার  

No comments:

Post a Comment