Monday, April 25, 2016

স্বর্গীয় রমণীয়(৯)

ত্রিভুবন ঘুরতে ঘুরতে দেবর্ষি নারদ একদিন মহাভারতের পান্ডব রাজসভায় আসেন।পান্ডবগণ যথোচিত মর্যাদায় নারদমুণির অভ্যর্থণা করলেন। নারদের সেখানে আগমনের কারণ ছিল রাজনীতি বিষয়ক।  দেবর্ষি রাজার উদ্দেশ্যে একগুচ্ছ প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিলেন। 
তিনি পান্ডবদের প্রশ্ন করলেন রাজাগণ কেবল অর্থচিন্তাতেই কালাতিবাহিত করছেন কিনা সেই নিয়ে। অর্থচিন্তার কারণে ধর্মচিন্তায় তাঁদের অনাসক্তি যেন না জন্মে এই ছিল নারদের চিন্তা। তিনি আরো বললেন, অর্থচিন্তাতো থাকবেই কিন্তু সেইসাথে রাজ্যের উন্নতিকল্পে বিবিধ উন্নয়নমূলক ক্রিয়াকর্মাদি যেমন, সেতুনির্মাণ, দুর্গনির্মাণ, পৌরকার্য্যাদি, জনপদ রক্ষণাবেক্ষণ...এইসব ঠিকমত সম্পাদিত হচ্ছে তো? কৃষি-বাণিজ্য-শিল্প-শিক্ষা-স্বাস্থ্যখাতে ঠিকমত অর্থাদি ব্যয় হচ্ছে তো? রাজ্যের কোষাগারে আয়ব্যয়ের হিসাবপত্র ঠিকমত রাখা হচ্ছে তো? তার রাজ্য চালাতে গেলে রাজাকে অষ্টবিধ রাজকার্য সম্যকভাবে সমাধা করতে হয়।  তিনি সে ব্যাপারে বেশ স্বচ্ছ তো? 

 রাজ্যের মঙ্গলার্থে শত্রু-মিত্র সকলের সহিত রাজা সুসম্পর্ক বজায় রাখেন তো? রাজার বাক্‌সংয্ম, বিনয় এবং অসূয়াপূর্ণ ব্যাবহার‌ই কিন্তু রাজ্যের উন্নতির জন্য অবশ্য কর্তব্য।   রাজা যেন কেবলি স্বার্থপরের ন্যায় তাঁর উপকারে লাগে এমন ব্যাক্তির সংসারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন। যুদ্ধে শত্রুপক্ষের দ্বারা ভীত, ক্ষীণবল মানুষজনের পাশে থাকাটাও তাঁর অবশ্য কর্তব্য। রাজকোষাগারের অর্থ কি রাজার ইচ্ছায় নয়ছয় হয়? শিল্পীমহল, বণিক সম্প্রদায় ও ঠিকাদারগণই কি  রাজতোষণ করে সমস্ত অর্থের সিংহভাগ লুটেপুটে নেন? হে রাজন্‌! আপনি কি তার হিসাব রাখেন? বৃদ্ধ, দরিদ্র, কৃষক, আশ্রিত, অনাথ ব্যাক্তিবর্গ কি সেই অর্থের ছিটেফোঁটাও ভোগ করেন না? রাজ্য মধ্যে মধ্যে নগর উন্নয়ন এবং পরিবেশ দূষণ রোধে বড় বড় পুষ্করিণী খনন হয়েছে কি? কৃষিকার্য মৌসুমীবায়ু নিরপেক্ষ হয়ে  সম্পন্ন হয়েছে কি? পৌরবর্গ ও জনপদবাসীর সঙ্গে আপনার বিরোধ নেই তো? আমি যতদূর জানি, রাজা নাস্তিকতা, অমৃতপান, নিদ্রা, কলহ, ক্রোধ , নিরন্তর অর্থচিন্তা, দীর্ঘসূত্রতা ইত্যাদি চৌদ্দটি রাজদোষ বর্জন করে রাজ্যাভিষেকের কালে শপথ নিয়ে সিংহাসনে বসেছিলেন। কিন্তু তা কি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন? 
যুদ্ধিষ্ঠির এতক্ষণ একটুও অস্থির না হয়ে শুনছিলেন দেবর্ষি নারদের প্রশ্নগুলি। নারদ থামলে তিনি বললেন, হে দেবর্ষি! আপনি এতক্ষণ যে ধর্মনিচয় প্রশ্নগুলি আমার উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করলেন তা অত্যন্ত ন্যায়সম্মত। আমি সাধ্যানুযায়ী আমার রাজ্যের কল্যাণে যতটা পারি পালন করে থাকি।    কিন্তু তবুও কিছু কিছু সত্কার্যের মধ্যে অঘটনস্বরূপ  সামান্য দোষ হয়েও যায়। এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। দেবর্ষি নারদ যারপরনেই খুশি হয়ে রাজা যুধিষ্ঠিরকে  বললেন, এযাবতকাল বহু স্থান পর্যটন করতে  গিয়ে বহু  রাজন্যবর্গের সহিত সাক্ষাত ও তাঁদের অনিন্দ্যসুন্দর  রাজসভা  পরিদর্শণ হয়েছে। কিন্তু আপনার মত রাজা আমি দেখিনি। আপনি সত্যি‌ই ধর্মরাজ।

অথ মহাভারত (সভাপর্ব) সমাপ্ত।

"বেশ হালকাভাবে নিলেন তো ব্যাপারটা! সত্যি আপনার ন্যায় স্থীতধী রাজা বিরল" নারদ ভাবলেন।
পাশ থেকে এক যেন ফিসফিস করে বলে উঠল,
" জানোনা তো? রাজ্যপাট চালাতে গেলে প্রচুর বুদ্ধির প্রয়োজন। মহারাজ যুধিষ্ঠির খুব ভালোভাবেই জানেন এসব রাজনৈতিক কূটকাচালী কি করে হ্যান্ডেল করতে হয়। কথায় কথা বাড়ে। কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তসাপ বেরিয়ে আসতে পারে! অতএব মৌনতাই সদ্‌বুদ্ধির লক্ষণ"

No comments:

Post a Comment